শিল্প সাহিত্য

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০২।। চিন্ময় দাশ

Published by
KGP Desk

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০২
চিন্ময় দাশদধিবামন মন্দির, ডিহি বলিহারপুর
(দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর) হুগলি (গঙ্গা) নদীর পশ্চিম পারে প্রাচীন মন্দির সংখ্যায় বেশি সম্ভবত মেদিনীপুর জেলাতেই। জেলার একেবারে পূর্ব এলাকায়, রূপনারায়ণ নদের পশ্চিম অববাহিকার কিছু মন্দির, নদীর পূর্বপারের সেনহাটের শিল্পীরা গড়েছিলেন। অন্য সবই গড়ে উঠেছিল মেদিনীপুর জেলারই শিল্পীদের হাতে।

রূপনারায়ণের লাগোয়া পশ্চিমে দাসপুর থানা। এই থানায় এক সময় মন্দির-নির্মাতা সূত্রধরদের একেবারে উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। অন্তত দু’শ পরিবার সূত্রধরের বাস ছিল দাসপুরে। দাসপুর, গৌরা, কলমিজোড়, গৌরা ইত্যাদি গ্রামে তাঁরা বাস করতেন। অবশ্য দাসপুর থানা ছাড়া, অন্য কয়েকটি থানাতেও কিছু সূত্রধরের বাস ছিল।
এক ডাকে সবাই চিনতেন, সেকালের এমন অন্তত ৩০ জন সূত্রধরের নাম আছে আমাদের কাছে। এঁদের পদবী হিসাবে কেবল শীল, চন্দ্র, দে এবং সাঁই—এই চারটির উল্লেখ পাওয়া যায়। বাকি অধিকাংশ সূত্রধরই তাঁদের নামের শেষে ‘মিস্ত্রী’ উল্লেখ করেছেন। কৌলিক পদবীর উল্লেখ পাওয়া যায় না। কেউ আবার একান্তই সংক্ষিপ্ত আকারে—শ্রীহরি, শত্রুঘ্ন, বৈষ্ণবদাস ইত্যাদি নিজের নামটুকুরই উল্লেখ করেছেন মাত্র।  সেসময়ে জেলার সূত্রধরদের মধ্যে যিনি অগ্রগন্য ছিলেন, তাঁর নাম ঠাকুরদাস শীল। ধনী জমিদারগণ ঠাকুরদাসের খাতায় নাম লিখিয়ে অপেক্ষা করতেন, তাঁকে দিয়েই মন্দির গড়াবেন বলে।
ঠাকুরদাসের জীবনকাল জানা যায় না। তবে, তাঁর কর্মজীবনের সময়কাল জানা যায়। ১৮৪৬ থেকে ১৮৬৫ সাল—এই কুড়ি বছরে তিনি ৭টি মন্দির এবং ১টি তুলসীমঞ্চ গড়েছিলেন। এবারের এই জার্ণালে যে মন্দিরটিকে আমরা উপজীব্য করেছি, সেটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৪৬ সালে। সূত্রধর ছিলেন ঠাকুরদাস। অর্থাৎ সেকালের অগ্রগণ্য শিল্পী ঠাকুরদাসের হাতের প্রথম নির্মাণকাজ এই মন্দির।
কেবল দাসপুর থানা নয়, রেশমশিল্পের সুবাদে সমগ্র ঘাটাল মহকুমা এক সময় অর্থ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। দাসপুর থানার ডিহি বলিহারপুর গ্রামে ধনী হয়ে উঠেছিল একটি ব্রাহ্মণবংশও। সেই বংশের জনৈক রাসবিহারী চক্রবর্তী বিষ্ণু আরাধনার জন্য, এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ‘দধিবামন’ নামের শালগ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মন্দিরে।
মন্দিরের গর্ভগৃহে, দ্বারপথের মাথার উপর, একটি প্রতিষ্ঠালিপি আছে। ৬ লাইনে লিখিত সেই লিপিতেই প্রতিষ্ঠাতার নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সাথে সূত্রধর হিসাবে ঠাকুরদাস শীল-এর নামটিও উল্লেখ আছে সেখানে।
সুদীর্ঘকাল চক্রবর্তীদের ব্রাহ্মণবংশটির কোন অস্তিত্বনাই। ১৯২৮ সালে একবার এই এলাকায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। বহু জীবনহানি ঘটেছিল তাতে। সেই মহামারীতে বংশটি সম্পূর্ণ অব্লুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
১৯২৮ সাল থেকেই মন্দিরটি পরিত্যক্ত। বিগ্রহটিও কার হেফাজতে গিয়েছে, হদিশ করা যায় না আর। অব্যবহারে অনাদরে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছে মন্দিরটি।
মন্দিরের ভিত্তিবেদী ছিল ফুট চারেক উঁচু। ইটের দক্ষিণমুখী সৌধ, পঞ্চ-রত্ন রীতির। সামনে খিলানের তিনটি দ্বার। গর্ভগৃহের মূল দ্বারটি ছাড়াও, পশ্চিমে অতিরিক্ত একটি দ্বার আছে। অলিন্দের সিলিং টানা-খিলানের। গর্ভগৃহের সিলিং গড়া হয়েছে দু’প্রস্থ খিলানের মাথায়, গম্বুজ রচনা করে। মাথায় পাঁচটি রত্নেই রথ-বিভাজন করা। রত্নগুলির শীর্ষক অংশ সম্পূর্ণ বিনষ্ট, দেখা যায় না।
একজন শিল্পীর হাতের প্রথম সৃষ্টি এটি। কিন্তু প্রথম কাজেই নিজের পারঙ্গমতা দেখিয়ে গিয়েছেন ঠাকুরদাস। মন্দিরের কার্ণিশগুলির বঙ্কিমভাবটি, সুন্দরী রমণীর আয়ত আঁখিপল্লবের মতো, মনোরম। গর্ভগৃহের পূর্বদিকের দেওয়ালে একটি ‘দ্বারবর্তিনী মূর্তি’ গড়েছিলেন। ভিনিশীয় রীতির এক-পাল্লা খোলা দ্বারপ্রান্তে, প্রিয়জনের প্রতিক্ষায় রত প্রেয়সীর মূর্তি। বর্তমানে সেটি ভারি জীর্ণ।
ঠাকুরদাস তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বুঝিয়েছিলেন মন্দিরের সামনের দেওয়ালে। প্রথম কাজেই টেরাকোটা ফলক রচনার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন তিনি।
কার্ণিশের নীচে সমান্তরাল দুটি সারি, দেওয়ালের দুটি কোণাচ অংশের গায়ে দুটি খাড়া সারিতে ফলক রচনা করেছিলেন ছোট ছোট খোপে। প্রতিটিতে একক মূর্তির সন্নিবেশ।
মূল ফলকগুলি রচিত হয়েছে তিনটি দ্বারপথের মাথায়, খিলানগুলির উপরের তিনটি বড় প্রস্থে। মোটিফ নির্বাচন করেছিলেন পুরাণকথা, রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি থেকে। কয়েকটি ছবি দেওয়া হোল। সকলেই ঠাকুরদাসের দক্ষতা উপলব্ধি করতে পারবেন।
পরিতাপের কথা, মন্দিরটি একেবারে ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছে। গাছের শেকড়, মহাকালের ভ্রুকুটি, স্থানীয়দের অত্যাচার—প্রতি দিন প্রতি পলে মন্দিরটির ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করে চলেছে। হা-হুতাস করবার লোকও নাই কেউ। সংরক্ষণ—সে তো অনেক দূরের কথা!
সমীক্ষা সঙ্গীঃ ১. শ্রী অমিত গুহ, AISHEE-র কর্ণধার—লণ্ডন। ২. শ্রী কমল ব্যানার্জী, INTACH-এর সদস্য, কলকাতা। ৩. শ্রী পুষ্পেন্দু সরকার, অধ্যাপক, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, মেদিনীপুর শহর।
পথ নির্দেশঃ পাঁশকুড়া রেল ষ্টেশন থেকে ঘাটাল্মুখী পথের উপর দাসপুর। সেখান থেকে সামান্য পূর্বমুখে চক্রবর্তীদের এই মন্দির।

Recent Posts

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, প্রজাবাড় (ময়না, পূর্ব মেদিনীপুর) যত দূর চোখ যায়, সবজি…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮ চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী দামোদরজীউ মন্দির, হাসিমপুর (কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর) মেদিনীপুর জেলার…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৭।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শিব মন্দির, মিত্রসেনপুর (চন্দ্রকোণা, পশ্চিম মেদিনীপুর)বহুকালের প্রাচীন নগরী চন্দ্রকোণা। ভানবংশ,…

11 months ago

Templ Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ২০৬।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশলক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, শ্রীরামপুর (সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর) জমিদারী গড়েছিলেন বটে, বৈষয়িক ছিলেন…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল- ২০৫।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী রসিকনাগর জীউ মন্দির, জয়ন্তীপুর (চন্দ্রকোণা শহর) মন্দির নগরী চন্দ্রকোণা। এর…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৪।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল— ২০৪ চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, মার্কণ্ডপুর (পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) রূপনারায়ণ নদ—মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের…

12 months ago