শিল্প সাহিত্য

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৯০ চিন্ময় দাশ

Published by
KGP Desk

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু মন্দির, পঁচেটগড়            (পটাশপুর , পূর্ব মেদিনীপুর)

জমিদারী এবং পঁচেটগড় রাজবাড়ির পত্তন হয়েছিল কালামুরারী দাস মহাপাত্র নামের উচ্চাকাংখী এক পুরুষের হাতে। ওড়িশার পুরী জেলায় রথিপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন তিনি। ভাগ্যাণ্বেষণে মেদিনীপুরে চলে আসেন তিনি।
শোনা যায়, কালামুরারী পার্সী ভাষায় সুদক্ষ ছিলেন। সেই সুবাদে, তাম্রলিপ্ত নগরীতে বিদেশী বণিকদের সাথে কাজ করে, বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। সেই অর্থে, কয়েকটি পরগণা কিনে নিয়ে, বেশ বড় মাপের একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালামুরারী।
রাজধানি করেছিলেন সেকালের প্রতাপভান পরগণায়। মহাদেব শিব জমিদারবংশের ইষ্টদেবতা। পাঁচটি শিব (ইষ্ট) প্রতিষ্ঠা করে, নতুন গড়ে ওঠা জনপদের নাম হয়েছিল– পঁচেট গ্রাম।
বিশাল বাস্তুকে ঘেরা হয়েছিল পর পর দুটি গভীর গড়খাই কেটে। ভিতরের ভাগে জমিদার পরিবারের বসবাস। বাইরের বেষ্টনীর ভিতর, চার দিকে কুমারসাই, গৌড়সাই, রঙ্গীনপাড়া ইত্যাদি চারটি পাড়া। বিভিন্ন জীবিকার বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায়ের ঘরবসত সেগুলিতে।
গড়হাভেলিতে পাঁচটি শিবালয় ছিল প্রথম থেকেই। পরে, সারা বাংলা জুড়ে, চৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্লাবন শুরু হয়। ঘরে ঘরে বিষ্ণু কিংবা শ্রীকৃষ্ণের আরাধনার প্রচলন হয় এই জেলা জুড়েও। প্রায় সমস্ত রাজবাড়ি এবং জমিদারবাড়িতে, নতুন করে মন্দির নির্মাণ করে, বিষ্ণু কিংবা শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপন করা হয়।
সেই স্রোতধারায় অবগাহন করেছিল পঁচেটগড়ের এই জমিদার পরিবারও। গড়হাভেলির ভিতরেই বিশালাকার মন্দির গড়ে কিশোররায়জীউ নামে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কুলদেবতা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল কিশোররায়জীউকে। বিপুল আড়ম্বরে সেবাপূজার প্রচলন হয়েছিল দেবতার। পঁচেটগড়ে কিশোররায়জীউর রাস উৎসবটি, চারশ’ বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে, আজও দক্ষিণবঙ্গে খ্যাত হয়ে আছে।
কিন্তু কিশোর রায় জীউর মন্দিরটি ভিতরগড়ে অবস্থিত। বিশেষ পূজা বা উৎসবে যোগদান করা গেলেও, বাইরের গড়ের চারটি পাড়ার অধিবাসীদের পক্ষে, নিত্যদিনের পূজায়, সামিল হওয়ার সুযোগ ছিল না। সুযোগ ছিল না তাঁদের নিজেদের দেবার্চনা করবারও।
সমীক্ষাকালে আমরা অনুসন্ধানে জেনেছি, ধর্মপ্রাণ এই জমিদারবংশ তাঁদের জমিদারী মহালের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিল যাতে প্রজাবর্গও বৈষ্ণবীয় রীতিতে দেবার্চনা করতে পারে। পটাশপুর থানারই গোকুল্পুর, চক শ্রীকৃষ্ণ, সাতষণ্ডা ইত্যাদি গ্রামগুলিতে সেসকল মন্দির আজও বিরাজিত আছে।
পঁচেটগড়েও, বাইরের গড়ের অধিবাসীদের জন্য, পশ্চিম পাড়ায়, ‘গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু’ নামের এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। রাধা-কৃষ্ণের সাথে গৌরাঙ্গ এবং নিত্যানন্দ—দুই প্রভুর বিগ্রহও নিত্য পূজিত হন মন্দিরে।
মন্দিরের পূজক হিসাবে, ‘উপাধ্যায়ী ব্রাহ্মণ’ আনা হয়েছিল বালেশ্বর জেলার আটগড় গ্রাম থেকে। প্রথম সেবাইত ছিলেন হরিনারায়ণ দাস অধিকারী। কথকতার গুণে, ‘কথক ঠাকুর’ নামে খ্যাত ছিলেন তিনি। তাঁরই বংশধর হিসাবে ৫টি পরিবার বর্তমানে মন্দির আর দেবতার সেবাইত বহাল আছে।
ইটের তৈরি পূর্বমুখী মন্দির। কলিঙ্গধারায়, শিখর দেউল রীতিতে নির্মিত হয়েছে। উঁচু পাদপীঠ বা ভিত্তিবেদীটির উপর প্রশস্ত একটি পরিক্রমা-পথ রাখা আছে।
সামনে আট-চালা রীতির জগমোহন এবং পিছনে শিখর রীতির বিমান বা মূল মন্দির। এই দুইয়ের মাঝখানে রীতি অনুসারে একটি অতি সংক্ষিপ্ত ‘অন্তরাল’ও নির্মিত আছে। জগমোহনের গর্ভগৃহের উচ্চতার তুলনায় মাথার ছাউনি চোখে পড়বার মত সংক্ষিপ্ত। বিমানের বাঢ় এবং গণ্ডী জুড়ে পঞ্চ-রথ বিভাজন করা।
দুটি সৌধেই ভিতরের সিলিং হয়েছে ছোট আকারের কতকগুলি খিলানের মাথায় গম্বুজ রচনা করে। আর, বাইরের শীর্ষক অংশে ক্রমান্বয়ে বেঁকি, আমলক, কলস এবং চক্র স্থাপিত। এক কথায় মন্দিরটি বেশ সুদর্শনই।
দুটি দ্বারপাল মূর্তি রচিত আছে। জগমোহনের দক্ষিণের দেওয়ালের উপর-অংশে একটি নারী-মূর্তি স্থাপিত। এছাড়া, মন্দিরে তেমন কোনও অলংকরণ নাই।
সাক্ষাৎকার (২০১৫ সাল)ঃ সর্ব চৌধুরী সমরেন্দ্র নন্দন দাস মহাপাত্র, পিনাকী নন্দন দাস মহাপাত্র, দিলীপ নন্দন দাস মহাপাত্র, রবীন্দ্র নন্দন দাস মহাপাত্র, যদু নন্দন দাস মহাপাত্র, সুব্রত নন্দন দাস মহাপাত্র, শ্রীমতি অপর্ণা দাস মহাপাত্র, শ্রীমতি ঋতুপর্ণা দাস মহাপাত্র—পঁচেটগড়, ভূবনেশ্বর, শান্তিনিকেতন ও কলকাতা।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর-দীঘা রাস্তার এগরা থেকে ৩ কিমি উত্তরে পঁচেটমোড়। এছাড়া, কলকাতা-দীঘা রুটের বাজকুল থেকে পশ্চিমে, কিংবা মুম্বাই রোডের ডেবরা বা বালিচক স্টেশন থেকে দক্ষিণে, এগরা মুখী রাস্তায় পঁচেট্মোড়। এবার ৩ কিমি পূর্বে জমিদারবাড়ি ও মন্দির।

Recent Posts

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, প্রজাবাড় (ময়না, পূর্ব মেদিনীপুর) যত দূর চোখ যায়, সবজি…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮ চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী দামোদরজীউ মন্দির, হাসিমপুর (কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর) মেদিনীপুর জেলার…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৭।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শিব মন্দির, মিত্রসেনপুর (চন্দ্রকোণা, পশ্চিম মেদিনীপুর)বহুকালের প্রাচীন নগরী চন্দ্রকোণা। ভানবংশ,…

11 months ago

Templ Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ২০৬।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশলক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, শ্রীরামপুর (সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর) জমিদারী গড়েছিলেন বটে, বৈষয়িক ছিলেন…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল- ২০৫।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী রসিকনাগর জীউ মন্দির, জয়ন্তীপুর (চন্দ্রকোণা শহর) মন্দির নগরী চন্দ্রকোণা। এর…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৪।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল— ২০৪ চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, মার্কণ্ডপুর (পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) রূপনারায়ণ নদ—মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের…

12 months ago