ক্রান্তিকালের মনীষা

ক্রান্তিকালের মনীষা-১২২: জসীমউদ্দীন ।। বিনোদ মন্ডল

Published by
KGP Desk

পল্লীকবি
জসীমউদ্দীন বিনোদ মন্ডল

দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় একটি কবিতা লেখেন তিনি। যখন নিজে একাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন ,তখন সেই কবিতাটি সরকারি বাংলা পাঠ্যপুস্তকে সংযোজিত হল। কবিতাটির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন -‘দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মতো তোমার কবিতা পড়ে আমি কেঁদেছি।’ সেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী জনপ্রিয় কবিতার নাম কবর। কবির নাম -জসীমউদ্দীন (১জানুয়ারি ১৯০৩ –১৩ মার্চ ১৯৭৬)।

পিতৃদত্ত পুরো নাম ছিল মোহাম্মদ জসীমউদ্দীন মোল্লা। কথিত আছে , নজরুলের পরামর্শে সাহিত্য ক্ষেত্রে শুধু জসীমউদ্দীন পরিচয় ব্যবহার শুরু করেন এই কবি, গীতিকার, অধ্যাপক, লোকসাহিত্য সংগ্রাহক। বাংলাদেশের ফরিদপুরের মানুষ তিনি। বাবা আনসারউদ্দীন মোল্লা ছিলেন শিক্ষক। মা – আমিনা খাতুন , ডাকনাম ছিল রাঙাছুট। ১৯২১সালে ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৯২৪এ রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচ. এস. সি. এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. (১৯২৯) এবং এম. এ. (১৯৩১) পাশ করেন তিনি।

কৈশোরে তাঁতিপাড়ার কবিয়াল রহিম মোল্লা এবং ফরিদপুরের ঈশাণ স্কুলের শিক্ষক ক্ষীরোদবাবুর সংস্পর্শে এসে কাব্যকবিতার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হন তিনি। গলায় ছিল সুর। উদাত্ত কণ্ঠে গাইতে পারতেন। স্বভাবতঃই বাংলার রাখালী, সারি, জারি, মুরশেদি , ভাটিয়ালি, বাউল এবং মারফতি গানের ধারায় পুষ্ট হন তিনি। হয়ে ওঠেন লোকসংগীতের উত্তরসাধক। কলকাতায় এম. এ. পাশ করার পর ড. দীনেশচন্দ্র সেনের গবেষণা সহযোগী হিসেবে পথ চলা শুরু করেন। সারা জীবনে দশ হাজারেরও বেশি লোকসংগীত সংগ্রহ করে মূল্যবান সংকলন করে গেছেন। ১৯৩৩ সালে ড. সেনের অধীনেই রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহায়ক পদে যোগ দেন।

পাঁচ বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা গবেষণার পর প্রভাষক হিসেবে (১৯৩৮)যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৪এ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে চাকরি নেন। অবসর গ্রহণ করেন, (১৯৬২) ডেপুটি ডিরেক্টর পদে আসীন হয়ে। তাঁর অধ্যাপক সত্তাকে ছাপিয়ে যায় শিল্পী সত্তা। পল্লী বাংলার অন্তর্লীন জীবন প্রবাহের সকরুণ ছবিটি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে তাঁর লেখায়। প্রথম প্রকাশিত দুটি কাব্যগ্রন্থ পাঠ করে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে “বাংলাদেশের মুসলমান চাষীদের প্রতিনিধিত্বকারী পল্লীকবি” হিসেবে অভিহিত করেন।

তারুণ্যেই তিনি উপলব্ধি করেন বঙ্গ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় না গেলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবেনা। বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে আসেন জসীম। দেখা করেন সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা মোসলেম ভারতের সম্পাদক মোজাম্মেল হকের সাথে। তাঁর কবর কবিতার জন্য ইতিমধ্যে খ্যাতি ছড়িয়েছিল। অন্যান্য কিছু কবিতা পড়েন ও ছাপার জন্য রেখে দেন হক সাহেব। পরামর্শ দেন তরুণ কবিদের হার্টথ্রব কাজী নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগের। নজরুলও সানন্দে বরণ করে নেন কবিকে। প্রাণিত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে অফুরান উদ্যমে কাজ শুরু করেন জসীমউদ্দীন।

জসীমউদ্দীনের প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম মিলন গান। ১৯২১সালে মোসলেম ভারত পত্রিকা প্রকাশ করে। কবর কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় কল্লোল পত্রিকায়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্য হল রাখালী (১৯২৭)। ১৯টি কবিতা বিশিষ্ট এই গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন ড. দীনেশচন্দ্র সেনকে। প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ নকশি কাঁথার মাঠ। উৎসর্গ করেছেন প্রাণপ্রিয় ব্ন্ধু আবদুল কাদিরকে। এই কাব্যের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সেকালের যশস্বী চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিতার ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কাজী নজরুল ইসলামের পাশাপাশি স্বকীয়তায় ভাস্বর হয়ে ওঠেন তিনি।

জসীমউদ্দীনের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), মাটির কান্না(১৯৫১) ,সুচয়নি (১৯৬১), পদ্মানদীর দেশে (১৯৬৯), জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫) , স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮) ইত্যাদি। তাঁর লেখা বাঙালীর হাসির গল্প (দুই খণ্ড ) ও বোবা কাহিনী উপন্যাস সুখপাঠ্য। ভূমিহীন কৃষকদের জীবনের অসীম দুঃখবেদনা, মহাজনের তীব্র শোষণ , সমাজপতিদের ভন্ডামি এই উপন্যাসের উপজীব্য। তাঁর জারিগান সংকলনে ২৩টি পালা বিধৃত। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। জসীমউদ্দীন রচিত কয়েকটি বিশিষ্ট নাটক হল -পদ্মাপাড়(১৯৫১), বেদের মেয়ে(১৯৫১), মধুমালা (১৯৫১), পল্লী বধূ (১৯৫৬) এবং গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯)। যাদের দেখেছি ও ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় গ্রন্থ দুটি স্মৃতিচারণ মূলক রচনা। আত্মজীবনী মূলক রচনা হল জীবন কথা (১৯৬৪)। তাঁর কোনো কোনো লেখা তুজম্মল আলী ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়।

শিশুতোষ রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – এক পয়সার বাঁশি (১৯৪৯), হসু (১৯৩৮), ডালিম কুমার (১০৫১)। তাঁর জীবদ্দশায় তিনটি গ্রন্থ ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। তাঁর নকশি কাঁথার মাঠ কাব্যটি ‘দি ফিল্ড অব্ এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট’ এবং সোজন বাদিয়ার ঘাট ‘জিপসি ওয়ার্ফ’ নামে অনূদিত। এছাড়া বাঙালির হাসির গল্পটি ‘ফোক টেলস্ অব ইস্ট পাকিস্তান’ নামে তরজমাকৃত।

গ্রাম বাংলার সম্বন্ধে যে উপলব্ধি সমগ্র রচনায় চারিত ও জারিত তার সারাৎসার খুঁজে পাওয়া যায় তাঁরই লেখায়. .. .. ‘দেশের অর্ধ শিক্ষিত আর শিক্ষিত সমাজ আমার পাঠক পাঠিকা। তাহাদের কাছে আমি গ্রামবাসীদের সুখ দুঃখ ও শোষণ পীড়নের কাহিনী বলিয়া শিক্ষিত সমাজের মধ্যে তাহাদের প্রতি সহানুভূতি জাগাইতে চেষ্টা করি ।আর চাই যারা দেশের এই অগণিত জনগণকে তাহাদের সহজ সরল জীবনের সুযোগ লইয়া তাহাদিগকে দারিদ্র্যের নির্বাসনে ফেলিয়া রাখে, তাহাদের বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষিত সমাজের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইতে। ‘
শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মণিমাণিক্যের মতো লোকগান সংগ্রহ করেননি , নিজেও বহু গান রচনা করেছেন জসীমউদ্দীন। বিখ্যাত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন তাঁর সহযোগিতায় বহু ভাটিয়ালি গানকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। এছাড়াও বেতারের জন্য বহু আধুনিক গান লিখেছেন কবি। প্রতিবেশী কবি গোলাম মোস্তফার প্রেরণায় রচনা করেছেন অনেক ইসলামিক সংগীত। জীবনের উপান্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে লিখেছেন কয়েকটি অসাধারণ দেশাত্মবোধক গান। তাঁর গানকে পরবর্তীকালে জনপ্রিয় করেছেন প্রখ্যাত সুরকার ও শিল্পী শচীনদেব বর্মনও।

তাঁর বহু গান আজও দুই বাংলার লোকসংগীত শিল্পী ও গবেষকদের উদ্দীপিত করে। কয়েকটি কালজয়ী গানের নমুনা হল – নদীর কূল নাই কিনার নাই, আমার সোনার ময়না পাখি ,আমায় ভাসাইলি রে , ব্ন্ধু কাজল ভ্রমরা রে, ও রঙিলা নায়ের মাঝি, নিশীথে যাইও ফুলবনেরে ভ্রমরা , ও আমার গহীন গাঙের নাইয়া , প্রাণ সখীরে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাংলা লোকসাহিত্যের দর্শন ও মননকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন কবি । ১৯৫৮ সালে ‘প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব্ পারফরমেন্স’ পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যলয় কবিকে সাম্মনিক ডি.লিট. প্রদান করে। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম ঘোষণা করলেও এই সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন কবি। তাঁর ভ্রমণ কাহিনী হলদে পরীর দেশে রচনার জন্য ‘ইউনেস্কো’ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে অর্জন করেন একুশে পদক। এছাড়াও ১৯৭৮সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয় তাঁকে।

তাঁর ইচ্ছা অনুসারে ফরিদপুর জেলার অম্বিকাপুরে তাঁর প্রিয় দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে কবিকে। সেখানে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে তাঁর স্মরণে জসীম মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

Recent Posts

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, প্রজাবাড় (ময়না, পূর্ব মেদিনীপুর) যত দূর চোখ যায়, সবজি…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮ চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী দামোদরজীউ মন্দির, হাসিমপুর (কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর) মেদিনীপুর জেলার…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৭।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শিব মন্দির, মিত্রসেনপুর (চন্দ্রকোণা, পশ্চিম মেদিনীপুর)বহুকালের প্রাচীন নগরী চন্দ্রকোণা। ভানবংশ,…

11 months ago

Templ Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ২০৬।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশলক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, শ্রীরামপুর (সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর) জমিদারী গড়েছিলেন বটে, বৈষয়িক ছিলেন…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল- ২০৫।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী রসিকনাগর জীউ মন্দির, জয়ন্তীপুর (চন্দ্রকোণা শহর) মন্দির নগরী চন্দ্রকোণা। এর…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৪।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল— ২০৪ চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, মার্কণ্ডপুর (পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) রূপনারায়ণ নদ—মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের…

12 months ago