প্রখ্যাত ছান্দসিক
প্রবোধচন্দ্র সেন
১৯২২ খ্রিস্টাব্দ। আসামের মুরারিচাঁদ কলেজে পাঠরত ইতিহাস অনার্সের এক ছাত্র ‘বাংলা ছন্দ’ নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। পাঠিয়ে দেন প্রবাসী পত্রিকার দপ্তরে ।পাঁচ কিস্তিতে ছাপা হয় তা। হইচই পড়ে যায় সাহিত্য মহলে। এর আগে কেউ এত সংহত আকারে বাংলা ছন্দ নিয়ে লেখেনি যে! জীবনে প্রথম প্রবন্ধ লিখেছেন ছন্দ নিয়ে, শেষ লেখাটিও ছিল ছন্দ বিষয়ক। তিনি প্রখ্যাত ছান্দসিক ও ঐতিহাসিক আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেন (২৭/০৪/১৮৯৭ —- ২৯/০৯/ ১৯৮৬)।
তাঁর প্রথম প্রবন্ধ পড়ে প্রশংসা করেছেন ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত , মোহিতলাল মজুমদার , কুমুদরঞ্জন মল্লিক , কালিদাস রায় ও কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ দিকপাল কবি।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সস্নেহে ছান্দসিক ‘উপাধি’ প্রদান করেন, যা তিনি আজীবন শিরস্ত্রাণের মতো ধারণ করতেন।
প্রবোধচন্দ্রের জন্ম পূর্ববঙ্গে,বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায়। ব্রাহ্মণবেড়িয়া মহকুমার চুন্টা গ্রামে। বাবা হরদাস সেন এবং মা স্বর্ণময়ী সেন। স্কুল কলেজের পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। স্কুলছাত্র প্রবোধ স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘অনুশীলন সমিতিতে’ যুক্ত হন। গুপ্তসমিতির সক্রিয় সদস্য হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করেন এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন (১৯১৫)।
ততদিনে ‘সমিতি’র দায়িত্বশীল সংগঠক হিসেবে পরিচিতি গড়ে ওঠে বিপ্লবী মহলে। খবর যায় পুলিশের কাছেও। ১৯১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আচমকা কয়েক জন সহপাঠী সহ তিনি গ্রেপ্তার হন। কুমিল্লার বাসায় ব্যাপক খানাতল্লাশি চালায় ব্রিটিশ পুলিশ। কুখ্যাত চার্লস টেগার্ট -এর ডান হাত পুলিশ কর্তা কোলসন এই অপারেশনের দায়িত্বে কলকাতা থেকে কুমিল্লায় ছুটে আসেন। পুলিশি প্রহরায় প্রবোধচন্দ্রকে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদের নামে দৈহিক ও মানসিক অত্যাচার চালানো হয়। তবু নৃশংস পীড়নেও তাঁর মুখ থেকে কোনো গোপন তথ্য বের করতে পারেননি কোলসন বাহিনী। কারাবাস হয় তাঁর। পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৮ সালে অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে তিনিও মুক্তি পান। তবে শর্ত দেওয়া হয় ,পাঁচ বছর নজরবন্দী থাকতে হবে। এবং এরপর বঙ্গদেশ থেকে বহিষ্কৃত হতে হয় তাঁকে।
অগত্যা শ্রীহট্টের মুরারিচাঁদ কলেজে ভর্তি হন এবং ইতিহাসে অনার্সসহ বি. এ. পাশ করেন। ফিরে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি’তে এম. এ. পাশ করেন। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল (১৯২৭) করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত গবেষক বৃত্তি নিয়ে গবেষণায় রত হন। ১৯২১ সালে ‘নজরবন্দী’ দশা থেকে মুক্ত হয়েই বরিশালে আয়োজিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে যোগ দেন প্রবোধচন্দ্র। এমনকি ১৯২৮ সালে কলকাতায় সংঘটিত নিখিল ভারত কংগ্রেস অধিবেশনেও স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করেন। এই অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান (জি. ও. সি. ) ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু আর সভাপতি হন মতিলাল নেহেরু। তবে পরবর্তীকালে প্রবোধচন্দ্র কোনো রাজনৈতিক পেনশন বা তাম্রপত্র গ্রহণ করেননি।
তাঁর অধ্যাপনা জীবন শুরু হয় ১৯৩২ সালে। খুলনা জেলার দৌলতপুর হিন্দু একাডেমিতে ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকরূপে। কথিত আছে তখন তাঁর বাংলা পড়ানোর যোগ্যতা নিয়ে শিক্ষা মহলে প্রশ্ন ওঠে। উনি তো ইতিহাসের লোক। পাশে দাঁড়ান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সুপারিশপত্র লিখে পাঠান। রক্ষা করেন তাঁর স্নেহের ‘ছান্দসিক’ প্রতিভাকে। প্রবাসীতে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রটির লেখা ‘বাংলা ছন্দ’ প্রবন্ধ পড়ে তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আলাপ করেছিলেন। আজীবন কবিগুরুর স্নেহচ্ছায়া লাভ করেছেন প্রবোধ। কবির মহাপ্রয়াণের পর ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন প্রবোধচন্দ্র। বিশ্বভারতীতে ‘রবীন্দ্র অধ্যাপক’ পদে যোগ দেন।
পূর্বপল্লীতে ‘রুচিরা’ নামে বাড়ি বানিয়েছিলেন এই ছন্দ বিশারদ। সেখানে তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন উপাচার্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত ও কবি অশোকবিজয় রাহা। ১৯৫১সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয় বিশ্বভারতী। তখন বাংলা বিভাগের প্রধান হন প্রবোধচন্দ্র। অবসর গ্রহণের পর (১৯৬৫)এখানেই এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে সম্মানজনক পদে বৃত হন। দীর্ঘ চৌষট্টি বছর একটানা ছন্দ -চর্চা করেছেন তিনি। বাংলা ছন্দের আদ্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস রচনা করেছেন। বাংলা ছন্দের পরিভাষায় বারংবার রূপান্তর এনেছেন। শেষ পর্যন্ত বাংলা ছন্দের তিনটি রীতির শিরোনাম স্থাপন করে গেছেন- মিশ্রবৃত্ত (অক্ষরবৃত্ত ), কলাবৃত্ত (মাত্রাবৃত্ত)ও দলবৃত্ত।
আজীবন রবীন্দ্র-অনুরাগী প্রবোধচন্দ্র লিখেছেন -‘রবীন্দ্র দৃষ্টিতে অশোক’ (১৯৫১), ‘রবীন্দ্র দৃষ্টিতে কালিদাস’ (১৯৬১), ‘ভারত পথিক রবীন্দ্রনাথ’ রচনা সংকলন। রবীন্দ্র চর্চায় অনন্য নিদর্শন ‘মালতীপুথি’র মূল্য নির্ধারণ। ‘রবীন্দ্র জিজ্ঞাসা’ প্রথম খণ্ডে এই সংক্রান্ত রচনা গুলির বিচার সংযোজিত। ‘রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা’, ‘রবীন্দ্রভাবনায় নারায়ণ’ ,’ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা’ প্রভৃতি গ্রন্থ আকর রূপে প্রজ্বলিত। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ‘ছন্দ’ গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন তিনি। ১৯৩১সালে কবিগুরুর সত্তর বর্ষ জন্ম জয়ন্তী পূর্তি উপলক্ষে জয়ন্তী উৎসর্গ নামে একটি অভিনন্দন গ্রন্থ সংকলিত হয়। সেই গ্রন্থের জন্য প্রবোধ লেখেন ‘বাংলা ছন্দে রবীন্দ্রনাথের দান’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ ।পরে ১৯৪৫ সালে ‘ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ’ নামে গ্রন্থরূপ লাভ করে যা প্রসিদ্ধি পেয়েছে।
ছন্দ পরিক্রমা (১৯৬৫), ছন্দ জিজ্ঞাসা (১৯৭৬), বাংলা ছন্দচিন্তার ক্রমবিকাশ (১৯৭৮), আধুনিক বাংলা ছন্দ সাহিত্য (১৯৮৫) তাঁর প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। বাংলা ছন্দ বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ‘যোগেন্দ্র মোহিনী’ স্মৃতি বক্তৃতাও প্রদান করেছেন তিনি।
স্বদেশের ইতিহাস নিয়ে তাঁর অপরিসীম আগ্রহ পরিলক্ষিত। যার ধারায় ছিল বঙ্কিম -বিবেকানন্দ -রবীন্দ্র মনীষা। যার পটভূমিতে ছিল ১৯০৫-১৯০৮ এর বঙ্গ ভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন। তাঁর দেশপ্রেম নিঃসৃত ইতিহাসপ্রীতি জন্ম দিয়েছে বাংলার ভৌগোলিক ইতিহাসের অনুধ্যান। ‘বাংলার জনপদ পরিচয়’ যার ফসল। ‘ধর্মবিজয়ী অশোক’ এবং ‘ধম্মপদ পরিচয়’ গ্রন্থদুটিও উল্লেখযোগ্য রচনা। ভারতের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে রচনা করেছেন ‘রামায়ণ ও ভারত সংস্কৃতি’ (১৯৬২) ,’ভারতাত্মা কালিদাস’ (১৯৭৩) গ্রন্থ দুটি। বাঙালির ইতিহাসচর্চা বিষয়ক গ্রন্থ বাংলার ইতিহাস সাধনা (১৯৫৩) অনন্য সৃষ্টি। মৃত্যুর পক্ষকাল পূর্বে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সুকুমার রায়ের কবিতার ছন্দ বিষয়ক শেষ লেখাটি (১৯৮৬)।
স্বাধীনভারতের জাতীয় সংগীত বিতর্কের সময় ‘জনগণমন’ সংগীতটির পাশে বলিষ্ঠ ভাবে দাঁড়িয়ে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন প্রবোধচন্দ্র। বামফ্রন্ট সরকারের মাতৃভাষায় উচ্চতর শিক্ষাদান নীতিরও সমর্থক ছিলেন তিনি। প্রশাসনিক কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারে সরকারি ঢিলেমির বিরুদ্ধে যেমন সদাসরব ছিলেন ,তেমনি বাংলা বানান সংস্কার নিয়ে সর্ববিধ গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিল তাঁর অবস্থান। ১৯৩৫ সালে যখন আনন্দবাজার পত্রিকা লাইনো টাইপের প্রবর্তন করে ,তিনি সমর্থন করেন এবং নিজ উদ্যোগে নিজের লেখায় বানান ও লিপি সংস্কার শুরু করেন। বাংলা আকাদেমি গঠিত হলে তিনি আশ্বস্ত হন এবং বাংলা ব্যাকরণ, বানান, পরিভাষা নিয়ে যথার্থ কাজ শুরু হবে, এই আশা ব্যক্ত করেন। বাংলা গদ্যরীতিতে তিনি এক স্বতন্ত্র ‘স্টাইলের’ প্রবর্তন করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের ‘জ্যাঠামশাই’ চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন প্রবোধচন্দ্রের আদলে। প্রথমে অগ্নিমন্ত্রের উপাসক পরে গান্ধির অহিংসনীতির অনুগামী। নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। প্রফুল্ল স্মৃতি পুরস্কার (১৯৬৯), কেশবচন্দ্র গুপ্ত স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৮), কল্যাণী ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডি. লিট. (১৯৮৩),বঙ্কিম পুরস্কার (১৯৭৩) এবং বিশ্ব ভারতী প্রদত্ত দেশিকোত্তম (১৯৮০)সম্মান। এছাড়াও এশিয়াটিক সোসাইটি ১৯৮৭সালে তাঁকে মরণোত্তর রবীন্দ্র শত বার্ষিকী স্মারক পদক প্রদান করেছে।
ঘুমের মধ্যে শরতের ভোরে মর্তবন্ধন ছিন্ন করেছেন ছান্দসিক। তাঁর ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী শান্তিনিকেতনে শ্মশানযাত্রায় কোনো আধ্যাত্মিক গান গাওয়া হয়নি। ললাটে চন্দনের পরিবর্তে লেপে দেওয়া হয় দেশের মাটি। ঈশ্বর, স্বর্গ, পরলোকে আস্থাহীন এই যুক্তিবাদী দেশ প্রেমিক-এর জীবন ও সৃষ্টি বর্তমান অন্ধকার সময়ে আমাদের শক্তি দিক ,প্রত্যাশা।
জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, প্রজাবাড় (ময়না, পূর্ব মেদিনীপুর) যত দূর চোখ যায়, সবজি…
জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ২০৮ চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী দামোদরজীউ মন্দির, হাসিমপুর (কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর) মেদিনীপুর জেলার…
জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শিব মন্দির, মিত্রসেনপুর (চন্দ্রকোণা, পশ্চিম মেদিনীপুর)বহুকালের প্রাচীন নগরী চন্দ্রকোণা। ভানবংশ,…
জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশলক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, শ্রীরামপুর (সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর) জমিদারী গড়েছিলেন বটে, বৈষয়িক ছিলেন…
জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী রসিকনাগর জীউ মন্দির, জয়ন্তীপুর (চন্দ্রকোণা শহর) মন্দির নগরী চন্দ্রকোণা। এর…
জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল— ২০৪ চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, মার্কণ্ডপুর (পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) রূপনারায়ণ নদ—মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের…