নিজস্ব সংবাদদাতা: ৩০ শে সেপ্টেম্বর রাত দেড়টা নাগাদ দিল্লি পুলিশের কাছে পূর্ব মেদিনীপুর পুলিশের এক আধিকারিক ফোন করে জানালেন, ” গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত এক ব্যাক্তি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে কিছুক্ষন আগেই কলকাতা বিমান বন্দর থেকে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। দিল্লিতে পৌঁছানোর সাথে সাথেই যেন তাঁকে আটক করা হয়। আমাদের পুলিশ রওনা দিচ্ছে তাঁকে আনার জন্য।” ওই ফোনের প্রায় দেড় ঘন্টা পরে দিল্লি বিমান বন্দরের লাউঞ্জে পা রাখেন সেই অভিযুক্ত হলদিয়া পুরসভার প্রাক্তন পুরপ্রধান শ্যামল আদক। আর পূর্ব মেদিনীপুর পুলিশকে কার্যত হতবাক করে দেয় সেই সময় কার বিমান বন্দরের লাউঞ্জের ছবিটা। দেখা যায় আট ব্যাক্তি কার্যত এসকর্ট করে শ্যামল আদককে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
‘হাউ ইজ ইট পসিবল?’ প্রায় বিস্মিত পূর্ব মেদিনীপুরের ওই পুলিশ কর্মকর্তা প্রশ্ন করেন? আমাদের হাতে যাকে তুলে দেওয়ার কথা তাকে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ! কারা ওই পুলিশ? দিল্লি পুলিশ নাকি অন্য কেউ। পূর্ব মেদিনীপুরের ওই পুলিশ কর্তার কথায়, ” দিল্লি পুলিশ হতে পারে, সি আই এস এফ হতে পারে কিন্তু ওরা পুলিশ। আট জনের মধ্যে ২ জন উর্দিধারী ছিলেন যার মধ্যে একজন আধিকারিক পর্যায়ের। তিন দুই তিন ছকে এসকর্ট করে অন্তত বিমান বন্দরের গেট অবধি এই দলটি শ্যামল আদককে যে পৌঁছে দিয়েছিল সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।” তিন দুই তিন ছক হল সামনে তিনজন পেছনে তিন জন আর দুপাশে এক এক দু’জন। অথচ কলকাতা বিমান বন্দরে শ্যামল আদককে একাই যেতে দেখা গেছে। পুলিশ বলছে খুবই হালকা একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে গলা বন্ধ সাদা ফুল শার্ট আর গ্রে রঙের ট্রাউজার পরা শ্যামল আদককে দমদম বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়ে যায় শুধুমাত্র ১ জন গাড়ির চালক।
পুলিশের ধারণা, সেদিন রাতেই দিল্লি বিমানবন্দর থেকে শ্যামল আদককে এসকর্ট করেই পৌঁছে দেওয়া হয় কাঁথির সাংসদ শিশির অধিকারীর নয়া দিল্লির বাস ভবনে। এখন সেখানেই রয়েছেন হলদিয়ার প্রাক্তন পুর পিতা শ্যামল আদক। বর্তমানে
সেই বাস ভবনের পাশেই রয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একজন ডেপুটি পুলিশ সুপার মর্যাদা সম্পন্ন পুলিশ আধিকারিক ও পুরো একটা পুলিশ টিম। তাঁরা সেখান থেকেই মাঝে মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন শ্যামল আদককে কিন্তু ছোঁয়া যাচ্ছেনা টিকি। সৌজন্যে দিল্লি পুলিশ! হ্যাঁ, এমনটাই অভিযোগ পূর্ব মেদিনীপুর পুলিশের।
পুলিশ বলছে, শুধু অভিযোগই নয় গত ২ রা অক্টোবর হলদিয়া মুখ্য দায়রা আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়েও দিল্লির পুলিশ আধিকারিকদের কাছে যাওয়া হয়েছে কিন্তু শিশির অধিকারীর বাসভবন রেইড করতে দিচ্ছে না তারা। “না নিজেরা রেইড করছে দিল্লি পুলিশ না আমাদের রেইড করতে সহযোগিতা করছে। আর দিল্লি পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া এই রেইড করা সম্ভব নয়।” জানান ওই পুলিশ আধিকারিক। সব দেখে শুনে পুলিশের মনে হচ্ছে পুজা অবকাশ কাটিয়ে হাইকোর্ট না খোলা অবধি শ্যামল দিল্লিতেই থাকবেন এবং দিল্লি থেকেই তিনি জামিনের আবেদন করবেন। উল্লেখ্য এর আগে বন্দরে তোলাবাজি সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করেও মুখ পুড়েছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পুলিশের। পুলিশের হাত থেকে সেই মামলা নিয়ে সিবিআইকে অর্পন করেন হাইকোর্ট পাশাপাশি শ্যামলকে গ্রেফতার করা যাবেনা বলেও জানিয়ে দেন।
এরপরই পূর্ব মেদিনীপুর পুলিশের এই দ্বিতীয় অভিযান। গত ২৯ সেপ্টেম্বর শ্যামল আদকের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতারনা, দুর্নীতি ইত্যাদি বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনেন প্রাক্তন পৌর প্রধানেরই একদা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার অরুনাংশু মুখার্জী। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে একাধিক জামিন অযোগ্য ধারা সহ ভারতীয় দন্ডবিধির সাতটি ধারায় মামলা দায়ের করে দ্বিতীয় দফার অভিযান শুরু করে হলদিয়ার ভবানীপুর থানার পুলিশ। যদিও এবারও এখনও অবধি অধরা শ্যামল। পুলিশকে কার্যত বোকা বানিয়েই ওই দিনই, অভিযোগ দায়েরের আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই দমদম বিমানবন্দর থেকে দিল্লি উড়ে যান শ্যামল আদক। আর এখানেও প্রশ্ন এত সতর্কতা ও গোপনীয়তা বজায় রাখা স্বত্ত্বেও শ্যামল আগে ভাগেই খবর পেলেন কী করে যে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে বা হতে চলেছে? পুলিশের এক আধিকারিক বলছেন,” এটা তো বাস বা লোকাল ট্রেন নয় যে একটা টিকিট কাটলাম আর চেপে বসলাম। এখানে বিমানের টিকিট জোগাড় করতে হয়েছে যা সাধারন ভাবে সময় সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রেও কোনও প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপে শ্যামল বিমানের টিকিট জোগাড় করে ছিল কিনা তাও ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাছাড়াও আমাদের মনে হচ্ছে তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দায়ের হতে চলেছে বা হয়েছে এই বিষয়টি শ্যামলকে দ্রুততার সঙ্গে জানানো হয়েছে হলদিয়া থেকেই। কে বা কারা এটা করল তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।” পুলিশের তরফে হলদিয়া পুরসভা থেকে এখনও অবধি ২০০ ফাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে যা শ্যামল আদক পুরপিতা থাকাকালীন টেন্ডার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত বলেই জানা যাচ্ছে।