নিজস্ব সংবাদদাতা: ভারতের শ্রেষ্ঠ রাবনদহন অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে খড়গপুর শহর অন্যতম। খড়গপুরে রাবন দহন দেখার জন্য ১০লক্ষ মানুষের উপস্থিতির রেকর্ড রয়েছে কিন্তু অসুর দহন খড়গপুর শহরের আরও একটি অনুষ্ঠান হল নরকাসুর দহন যা প্রায় পাড়ায় পাড়ায় এমন কী অনেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই শহরে রাবন দহন যেমন সার্বজনীন, নরকাসুর দহন তেমনি গনউৎসবের আকার নেয়। পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে সেদিন নরকাসুর দহনের প্রস্তুতি। এ জিনিস দেখতে গেলে শুধু খড়গপুরেই আসতে হবে। উত্তরভারত সহ দেশের বিভিন্ন অংশে পালিত হয় নরকচতুর্দশী যেমন কালীপুজোর আগের দিন বাঙালির ভূত চতুর্দশী ঠিক তেমনই দক্ষিণ ভারতীয়দের প্রিয় অনুষ্ঠান নরকাসুর দহন। তাই এই নরকাসুর দহন দেখার জন্য আসতে হবে খড়গপুর শহরের সেই সমস্ত এলাকায় যেখানে দক্ষিণীদের সর্বাধিক বসবাস।
ভূত চতুর্দশী ঘিরে বলি দানবের কাহিনি অনেকেই জানেন। তবে নরক চতুর্দশী ঘিরে কোন কোন কাহিনী প্রচলিত রয়েছে দেখা যাক। নরকাসুর হলেন নরকের দেবতা তিনি বিষ্ণুর অন্যতম অবতার বরাহ এবং ভূদেবীর সন্তান নরকাসুর। বরাহ যেমন বিষ্ণুর অবতার ভূদেবী বা পৃথিবী মাতা তেমনই লক্ষ্মীরই অংশ। সেই অর্থে নরকাসুর কিন্তু বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর পুত্র। এক কঠিন তপস্যায় নরকাসুর প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছ থেকে এমন বরলাভ করেন যাতে তার মা ভূদেবী ছাড়া নরকাসুরকে কেউ হত্যা করতে পারবে না। এরপর অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন নরকাসুর। সাম্রাজ্য বিস্তার করলেন প্রাগজ্যোতিষ বা আজকের অসম অবধি। কামরূপে রাজধানী স্থাপন করলেন। এই সময় তিনি কামাক্ষ্যা দেবীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। দেবী শর্তদেন এক রাতে মোরগ ডাকার আগেই নীলাচল পাহাড়ের তলা থেকে কামরূপ অবধি সিঁড়ি বানাতে হবে। নরকাসুর সেই শর্ত পালন প্রায় করেই ফেললেন কিন্তু প্রবঞ্চনা করলেন দেবী। ভোর রাতে সিঁড়ি যখন প্রায় শেষ তখনও মোরগ ডাকেনি। দেবী নিজেই একটি মোরগকে জোরে চেপে ধরলেন। যন্ত্রনায় মোরগটি ডেকে উঠল। অসমাপ্ত থেকে গেল সিঁড়ি নির্মাণ। ক্রুদ্ধ নরকাসুর মোরগটিকে কেটে ফেললেন। আসমের সেই জায়গার নাম আজও মোরগকটা।
এরপর স্বর্গ আক্রমন করলেন নরকাসুর। ইন্দ্র ভয়ে পালালেন। অবশেষে কৃষ্ণের স্মরণাপন্ন হন দেবতারা। প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। কীভাবে নরকাসুর বধ হন এ নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। একটি মতে নরকাসুরের মা ভূদেবীর রূপ ধারণ করে অসুর দমন করেন শ্রীকৃষ্ণ। অন্যমতে নরকসুরের বর্জ্রের আঘাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার ভান করেন শ্রীকৃষ্ণ। সত্যভামা পেছনে থেকে সুদর্শন চক্র দিয়ে তাঁর গলা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। সত্যভামা ভূদেবীরই অংশ। যেভাবেই হোক তাঁকে ছলনা করেই হত্যা করা হয় এটা মনে করেন দক্ষিণীরা। নরকাসুর সত্যভামার কাছে শেষ বর প্রার্থনা করেন তাঁর মৃত্যুর দিনটি যেন আলোকজ্জ্বল করা হয়। দেবী সেই শর্ত মেনে নেন।
আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণের কাছে নরকাসুর অনুরোধ করেন যে, পৃথিবীতে এমন একটি দিন যেন তার নামে দেওয়া হয়, যেদিন নরকাসুপরকে সকলে পুজো করবে। আর এভাবেই নরকাসুর অমর হয়ে থাকবে। ‘তথাস্তু’ বলে দেন শ্রীকৃষ্ণও। এরপরই নরক চতুর্দশীর দিন নরকাসুরের উদ্দেশে পুজোপাঠ হয়। যাতে আসুরিক অন্ধকার বিশ্বের ক্ষতি সাধন না করে। বহু জায়গায় ছোটি দিওয়ালি হিসাবে নরক চতুর্দশী পুজো হয়। মূলত দক্ষিণ ভারতে আড়ম্বর সহকারে নরকচতুর্দশী পালিত হয়। এদিন বহু বাড়িতে অলক্ষ্মীর পুজো বা যমের পুজো করে তাঁদের তুষ্ট রাখা হয়।
অনেকের মতে দেব অধিগৃহীত বিশ্বে সংখ্যালঘু হয়ে পড়া তাঁর অনুগামীরা যাতে বছরের একটি দিন অন্ততঃ তাঁর উপাসনা করতে পারেন তারই ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন নরকাসুর। তাঁর অনুগামীদের কাছে তিনি আজও উপাস্য এবং শহীদের মর্যাদা পান। নরকাসুর দহন আদতে তাঁকে পূজো করা ঠিক যেমনটা তিনি চেয়েছিলেন সেই আলোকজ্জ্বল ভাবেই। অনেক স্থানেই তাঁকে সুন্দর, বলিষ্ঠ, সৌমিকান্তি এক বীর হিসাবেই চিত্রিত করা হয় খড়গপুরের নরকাসুরও সেই ভাবে নির্মিত হন। খড়গপুর শহরের খরিদা, মালঞ্চ, নিমপুরা, মথুরাকাটি এলাকায় মূলতঃ খুব জাঁকজমক করে এই অনুষ্ঠান হয়। এখানকার দক্ষিনীদের পাশাপাশি এখন বাঙালিরাও মেতে ওঠেন এই উৎসবে। ছবি: খড়গপুরের বিভিন্ন এলাকার এবং সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নেওয়া।