নিজস্ব সংবাদদাতা: আবারও সেই পরীক্ষার মাঝে মা হওয়ার ঘটনা এবং এবার খড়গপুর। খড়গপুর গ্রামীন থানার শাকপাড়া গ্রামের এক নাবালিকা সন্তান প্রসব করেছেন পরীক্ষার পঞ্চম দিনে। খড়গপুর গোপালী ইন্দ্রনারায়ন বিদ্যালয়ে পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত আসন স্থির হয়েছিল তার। শনিবার পঞ্চম দিনের পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি যাওয়ার পর তার প্রসব বেদনা ওঠে। ওইদিন মধ্যরাতের পর অর্থাৎ রবিবার হিজলী গ্রামীন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে একটি কন্যা সন্তান প্রসব করে সে। সোমবার ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই পরীক্ষা দিচ্ছে নাবালিকা। সংবাদ মাধ্যমে পরীক্ষা শুরুর দিনই দু’জনের মা হওয়ার খবর প্রকাশ হয়েছিল। তারপর প্রায় প্রতিদিনই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে নাবালিকা মা হওয়ার খবর এসেই যাচ্ছে যা পঞ্চম দিনেও অব্যাহত রইল।
পরীক্ষার প্রথম দিন ৭ই মার্চ একই সঙ্গে দুই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মা হওয়ার খবর আসে কোচবিহারের দিনহাটা ও মালদার হরিশচন্দ্রপুর থেকে। এরপর একে একে খবর এসেছে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর এমনকি কলকাতা ছোঁয়া সন্তোষপুর থেকে। পূর্ব মেদিনীপুর ভগবানপুর পাঁউসির এক নাবালিকা পরীক্ষার্থী আড়াই বছরের পুত্র সন্তানের মা! সুতাহাটা থানার পাথরবেড়িয়ার পরীক্ষার্থী সদ্য প্রসূতি। কলকাতার সন্তোষপুরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে আসার পথে হঠাৎ অসুস্থ। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন সে অন্তঃসত্ত্বা!
খবরে আসেইনি এমন ঘটনার একটা ছোট উদাহরণ জঙ্গলমহলের একটি স্কুল। গড়বেতা-৩ ব্লকের ওই স্কুলটিতে দুটি স্কুলের পরীক্ষা কেন্দ্র পড়েছে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেছেন, ‘ আমার স্কুলে যেমন দুটি স্কুলের পরীক্ষা কেন্দ্র হয়েছে তেমনই আমার স্কুলের পরীক্ষার্থীদের অন্য জায়গায় আসন পড়েছে। সব মিলিয়ে এই তিনটি স্কুলে আসন্ন প্রসবা অথবা আগেই প্রসব করেছে এমন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ জন। আমার স্কুলে একজন ১জন পূর্নগর্ভা পরীক্ষা দেবে বলে আগে থেকে জেনেছিলাম। কিন্তু গোল বাধল ইংরেজী পরীক্ষার দিন। আধঘন্টা পরীক্ষা দেওয়ার পর এক ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখেন মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। তাকে বুঝিয়ে স্কুলেই পরীক্ষা দেওয়া করিয়েছি। আমাদের জানা এই মোট দুজন অন্তঃসত্ত্বা পরীক্ষা দিচ্ছে। একজন সদ্য প্রসূতি পরীক্ষা দেবে বলে সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানিয়েছিলেন কিন্তু শেষ অবধি সে পরীক্ষা দিতে আসেনি। আমার স্কুলের একটি মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা ছিল। তার অন্যস্কুলে পরীক্ষা কেন্দ্র পড়েছিল। সম্ভবতঃ সেও পরীক্ষা দিচ্ছেনা।’ গড়বেতা-৩ ব্লকে মোট ১৩টি পরীক্ষা কেন্দ্র। ওই প্রধানশিক্ষকের দাবি প্রতিটি শিক্ষা কেন্দ্রে দু’তিনটি করে এই ঘটনা পাওয়া যাবে। পাশের ব্লকও জঙ্গলমহলের শালবনী। একটি স্কুলের প্রধানশিক্ষক জানালেন, তাঁদের স্কুলে একটিই স্কুলের পরীক্ষাকেন্দ্র। অন্ততঃ ২জন বিবাহিতা পরীক্ষা দিচ্ছে এবং তাঁদের স্কুল থেকে অন্য স্কুলে পরীক্ষা দিচ্ছে এমন ২জন পরীক্ষার্থী বিবাহিতা।
গোটা ঘটনায় রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক সমাজ ও সমাজবিদরা। মাত্র ১৬ থেকে ১৭ বছরেই মা! একজন বা দু’জন নয় এই মাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যেই সংবাদমাধম্যে উঠে এসেছে অন্ততঃ ১০জনের নাম। আর সংবাদমাধ্যমে উঠে আসেনি অথবা মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগে প্রসব করেছেন কিংবা পরীক্ষার সময় অন্তঃসত্ত্বা যারা কয়েকদিন বাদেই প্রসব করবেন অথবা যারা পরীক্ষা দিচ্ছেই না! সংখ্যাটা কত? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংবাদমাধ্যমে খবর হচ্ছে ওই নাবালিকা মায়ের কৃতিত্ব নিয়েই। যে দেখ মেয়েটির পড়াশুনার কত আগ্রহ, সদ্য প্রসূতি পরীক্ষা দিচ্ছে হাসপাতালের বেডে। কেউ এই প্রশ্নটা তুলছেই না যে বাচ্চা প্রসব করা তো পরের কথা মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল কী ভাবে? কোথায় ছিলেন জেলার সমাজ কল্যাণ, শিশুকল্যাণ দপ্তরের আধিকারিকরা?
শিক্ষক সংগঠনের নেতৃত্ব বলছেন এক ভয়াবহ চিত্র উঠে আসবে যদি শুধু এটা নিয়ে সার্ভে করা যায়। তাঁদের মতে এর বড় কারণ লকডাউনে দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকা এবং সরকারের সমাজকল্যাণ, শিশুকল্যাণ, নারীকল্যাণ দপ্তরের অপরিণামদর্শীতা, অযোগ্যতা। একটা বড় অংশের নাবালিকা এই লকডাউনের সময় যেমন পালিয়ে বিয়ে করেছে তেমনই প্রবল দারিদ্র্য, লকডাউনে চেপে বসা আর্থিক সঙ্কট থেকেও অনেকে কন্যা বিদায় দিয়ে মুক্তি খুঁজছে নাবালিকার বিয়ে দিয়ে। রাজ্য জুড়ে হাজার হাজার ছাত্রী থাকত সরকারি হোস্টেলে। সরকারের পোষনেই তাদের তিনবেলার খাবার জুটত। দু’বছর হোস্টেল বন্ধ থাকায় এদের বড় অংশ ছিটকে গেছে মূল স্রোত থেকে। রাজ্য বিদ্যালয় প্রধানদের সংগঠন ‘অ্যাডভান্সড সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেসস্’ এর সাধারণ সম্পাদক চন্দন মাইতি বলেছেন, ” ভয়ঙ্কর ক্ষতি করেছে লকডাউন কিন্তু তারও চেয়ে ভয়ঙ্কর ক্ষতি করেছে দিনের পর দিন স্কুল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত। সমস্ত শৃঙ্খলা, সমস্ত নজরদারি শেষ হয়ে গেছে ওই সময় যার অবধারিত ফল হিসাবেই এই নাবালিকা বিবাহ ও নাবালিকা মা।” একই কথা বলেছেন, রাজ্যের শিক্ষক সংগঠন ‘ শিক্ষক শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী। তিনি বলেন, ‘ আমরা বহু আগে থেকেই এই ধরনের আশঙ্কা করেই বারংবার স্কুল খুলে দেওয়ার দাবি করেছিলাম সরকারের কাছে। উপযুক্ত কোভিড বিধি মেনে আরও আগে স্কুল খুলে দিলে এতটা সর্বনাশ হতনা।’