নরেশ জানা : রবীন্দ্র সঙ্গীতকে যে কয়েকজন চলচ্চিত্রকার তাঁদের নির্মাণে প্রয়োগ করে একটি নতুন ধারা যুক্ত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে তরুণ মজুমদার অন্যতম। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে সাড়ে চুয়াত্তর কিংবা সপ্তপদী পেরিয়ে আসা চলচ্চিত্রপ্রেমী বাঙালিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতেও প্রেম করতে শিখিয়েছিলেন তিনিই। যে বাঙালি প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘প্যানপ্যানানি’ মনে হত সেই প্রেমিক প্রেমিকা জুটিকেও নিজের অজান্তেই দু’ছত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়ে ছেড়েছেন তিনি। শুধু চিত্রনাট্য নয়, রবীন্দ্রসঙ্গীতের জেরেও হাউসফুল করিয়ে ছেড়েছেন দাদারকীর্তি কিংবা ভালোবাসা ভালোবাসা কে। সেই রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর জীবনের কতটা জুড়ে ছিল তা প্রমাণ করে দিলেন, ৩রা জুলাই তাঁর শেষ যাত্রাতেও। ৯১ বছরে তিনি যখন অচিনপুরের ঠিকানায় পাড়ি দিলেন, তখন তাঁরই ইচ্ছানুসারে তাঁর বুকে গীতাঞ্জলি!
নিজের চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে তিনি একটি বৃহৎ অংশের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতকেও জনপ্রিয় করে গেছেন এটা অস্বীকার করার উপায় নেই কিন্তু তিনি নিজে তা কখনও বলেননি, এমনকি শুধুমাত্র সেই বিষয়ে তাঁকে বলার জন্য যখন শুধু তাঁরই জন্য একটি বৃহৎ মঞ্চ আয়োজিত হয়েছিল সেখানেও নীরব ছিলেন তিনি। ৪ জুলাই, তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই নিজের ওয়ালে লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার বলছেন, ” শিলিগুড়িতে তরুণবাবু আমন্ত্রিত হয়েছেন ‘বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত’ নিয়ে বক্তৃতা দিতে। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে। উদ্যোক্তারা তরুণবাবুকে এই বিষয়ে বলতে ডেকেছিল এ জন্যই কারণ তিনি নিজের চলচ্চিত্রে খুব বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন। উদ্যোক্তাদের তরুণবাবুকে চিনতে ভুল হয়েছিল। তরুণবাবু তাঁর বক্তৃতায় প্রমথেশ বড়ুয়ার যুগ থেকে সত্যজিৎ ঋত্বিক হয়ে সাম্প্রতিক অবধি চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ নিয়ে অসাধারণ লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। নিজের ছবি নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না।”
শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার বলছেন, “বক্তৃতা শেষে হতেই শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন, আশা অপূর্ণ রয়ে গেল। নিজের ছবি নিয়ে যদি একটু বলতেন! সকলেই গুঞ্জন করছে। সকলের হয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বললেন, আমাদের খুব প্রতীক্ষা ছিল আপনি নিজের ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ নিয়ে কিছু বলবেন। একটু যদি বলেন। তরুণবাবু শান্তভাবে বললেন, ওটা তো আপনারা বলবেন।” এখন, এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন অন্য কারোর জন্য বলার আমন্ত্রণ পেয়ে আদতে অনেকেই নিজের হয়ে ঢোল পেটানোকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেন এবং তাই-ই করে যান তখন নিজের স্বপক্ষে ঢোল পেটানোর সুযোগ পেয়েও ঢোলের কাঠি অবলীলায় হাত থেকে ফেলে দিতে পারেন তরুণ মজুমদারই। এ হেন মানুষই নিজের শেষযাত্রায় গীতা ছেড়ে গীতাঞ্জলির আশ্রয় নিতে পারেন!
বাংলায় এখন মৃতদেহ দখলের যুগ! কখন কোন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব গুরুতর অসুস্থ হয়ে কোন সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন তা নজরে রাখার জন্য নবান্নের দু’একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক মোতায়েন হন। ভর্তি হওয়ার সংবাদ পাওয়া মাত্রই একটি মহার্ঘ্য পুষ্পস্তবক সরকারের প্রধানের হয়ে পৌঁছে দিতে হয়। তারপর তক্কে তক্কে থাকা। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। আর তেমন খবর পেলেই দ্রুত সরকারের তরফে তাঁর দখল নেওয়া। প্রয়োজনে শেষযাত্রায় মুখ্যমন্ত্রীও হাঁটবেন। মহাশ্বেতা দেবী থেকে শুরু করে কে.কে অবধি অনেকের ক্ষেত্রেই এই দখলদারির প্রমান মিলেছে। তরুণ মজুমদার সেই বিড়ম্বনা থেকে নিজের শবদেহটি বাঁচানোর ব্যবস্থা করে গেছেন। না, শুধু তিনিই নয় আরও কেউ কেউ। কিন্তু গীতার পরিবর্তে গীতাঞ্জলিকে শেষযাত্রার সঙ্গী তিনিই করেছেন। এই হল তাঁর রবীন্দ্রনাথে আশ্রয়, আমৃত্যু!
বামপন্থীদের অনেকেই হয়ত রবীন্দ্রানুরাগী। তাঁদের অনেককেই হয়ত সত্যি সত্যি গীতার চাইতে গীতাঞ্জলিকেই জীবনের ধ্রুবতারা করেছেন কিন্তু শেষযাত্রায় বুকের ওপর গীতাঞ্জলি নিয়ে যাওয়ার কথা তরুণ মজুমদারই ভাবতে পারেন। আস্তিকতা কিংবা নাস্তিকতা প্রতিটি মানুষের নিজস্ব প্রত্যয় যদিও আস্তিকতা যেভাবে মানুষ জন্মসূত্রে গ্রহণ করে নাস্তিকতা সেভাবে গ্রহণ করেননা। নাস্তিকতা অর্জনের লড়াইটা নাস্তিক মানুষদের সারা জীবন চালিয়ে যেতে হয় কারন বিপক্ষের দর্শনটা অনেকবেশি পুরানো, অনেক বেশি সংক্রামকও বটে। আস্তিকতা তার স্বভাবসুলভ ঐতিহ্য থেকেই উত্তরাধিকার রেখে যায় কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাস্তিকতা সেই ধারা রাখতে ব্যর্থ হয়। তরুণ মজুমদার নাস্তিকতা চর্চার সেই উপাদান, সেই দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন। মৃত্যুর পর দেহদান, শেষযাত্রায় হইচই না করে নীরব প্রস্থান ইত্যাদি বেশকিছু ধারা ধীরে ধীরে সমাজের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ঠ হচ্ছে। এবার সেই পথে গীতাঞ্জলি বুকে নিয়ে শেষযাত্রা। নিশ্চিতভাবেই তরুণ মজুমদারের দেখানো এই পথে এবার থেকে অনেকেই হাঁটবেন।