জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
দামোদর মন্দির, কাতরাবালি (গড়বেতা)
ইং ১৭০২ সালে বর্ধমানের অধিপতি রাজা কীর্তিচন্দ্র এক ভয়ংকর যুদ্ধে, চন্দ্রকোণার তৎকালীন রাজা রঘুনাথ সিংহকে নিধন এবং বরদা-চেতুয়ার রাজা হিম্মত সিংহকে পরাজিত করে, চন্দ্রকোণা এবং বরদা দুটি রাজ্যই অধিকার করে নিয়েছিলেন। রাজকার্য পরিচালনার জন্য নতুন করে তোষাখানা, হাতিশাল, ঘোড়াশাল ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সাথে চন্দ্রকোণার অযোধ্যাপল্লীতে স্থাপন করা হয়েছিল বড়সড় একটি কাছাড়িবাড়িও। বিভিন্ন পদে কর্মী নিযুক্ত হয়েছিল নতুন করে।
হুগলি জেলার তিলাডি গ্রামের অধিবাসী এক ব্যক্তি এসেছিলেন কাছারির নায়েব হিসাবে। তাঁর নামটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ প্রায় সওয়া তিন শ’ বছরে তাঁর বংশধরগণও নামটি বিস্মৃত হয়েছেন।
নিজের সততা, কর্মনিষ্ঠা, এবং বিচক্ষণতার গুণে, বাংলার নবার দরবার থেকে ‘সরকার’ খেতাব পেয়েছিলেন সেই নায়েব মশাই। তখন থেকে এই বংশ নিজেরদের কৌলিক পদবী ত্যাগ করে, সরকার পদবী ব্যবহার করে আসছেন। পরে পরে, এই বংশ নিজেদের একটি জমিদারীও প্রতিষ্ঠা করেছিল।
৬ জন পুত্র ছিল নায়েব মশাইর। তাঁদের পরিবারবর্গই, মেদিনীপুর জেলার একেবারে উত্তর-পূর্ব কোণে, কাতরাবালি গ্রামে বাস করে আছেন। পরে পরিবার বৃদ্ধির কারণে, তিনটি পৃথক ‘বাখুল’-এ ভাগ হয়ে, বসবাস করছেন তাঁরা।
ইং ১৭৫৭ সাল। বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক মহা সন্ধিক্ষণ। লর্ড ক্লাইভের সাথে যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় এবং মৃত্যু। সেই বছরেই নায়েব মশাইর জ্যেষ্ঠ পুত্র গদাধর সরকার বিষ্ণুকে কুলদেবতা হিসাবে গ্রহণ করে, ‘রাধা-দামোদর’-এর নামে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
যতদূর অনুমান করা যায়, হুগলি থেকে আগত পরিবারটিতে পূর্বকাল থেকে শৈব-শাক্ত মতে পূজার্চনার প্রচলন ছিল। কেন না, এর ঠিক ৫০ বছর পরে, ১৮০৭ সালে, গদাধরের পুত্র বাসুদেব দুর্গাপূজার জন্য একটি দুর্গাদালান এবং ঘন্টেশ্বর শিব নামক একটি শিবমন্দিরও স্থাপন করেছিলেন। আবার, এর প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পরে, বাংলা ১২৬০ সন বা ইং ১৮৫৩ সালে, বাসুদেবের দুই পুত্র সর্বানন্দ এবং যজ্ঞেশ্বর পুণরায় সেই একই চত্ত্বরে, ১২টি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বর্তমান আলোচ্চ দামোদর মন্দিরের সেবাইত বংশের অভিমত যে, বাংলায় মোগল শাসন পতনের আগেই, সরকারবংশ গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মকে আশ্রয় করেছিলেন। কুলদেবতা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল ‘দামোদরজীউ’কে। ১৭৫৭ সালে রাধা-দামোদর নামিত মন্দির স্থাপন বা পলাশী যুদ্ধের পূর্বেই দামোদরের এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। সেই হিসাবে, ১৭০২ সালে কীর্তিচন্দ্রের চন্দ্রকোণা অধিকার এবং কাছারিবাড়ী স্থাপন থেকে, ১৭৫৭ সালে রাধা-দামোদর মন্দির প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত কালপর্বের কোন এক সময়ে বর্তমান মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এমন অনুমান করা যেতে পারে।
ইটের তৈরি পূর্বমুখী মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে আট-চালা রীতিতে। দীর্ঘ প্রায় তিন শ’ বছরে মন্দিরের ভিত্তিবেদীর সিংহভাগই ভূমিগত হয়ে গিয়েছে। তবে, ভিত্তিবেদীর উপর মন্দিরকে বেষ্টন করে থাকা প্রদক্ষিণ-পথটি এখনও টিকে আছে।
দুটি অংশ মন্দিরের— সামনে অলিন্দ এবং পিছনে গর্ভগৃহ। অলিন্দটিতে খিলান-রীতির প্রায় সমোচ্চ তিনটি দ্বারপথ। থামগুলি চারটি করে গোলাকার থামের গুচ্ছ।
অলিন্দের ভিতরের ছাদ বা সিলিং হয়েছে টানা-খিলান রীতিতে। গর্ভগৃহের সিলিংয়ে প্রথমে দু’দিকে দুটি পূর্ণ-খিলান, পরে চারদিকে চারটি অর্ধাকার পাশ-খিলানের মাথায় গম্বুজ স্থাপন করা হয়েছে।
মন্দিরের ছাউনির চালাগুলির গড়ন লক্ষ্য করবার মত। দেওয়াল থেকে উত্তুঙ্গ না হয়ে, দেওয়ালে লেপ্টে আছে। সেকারণে কার্ণিশের স্বাভাবিক সৌন্দর্যটি সৃষ্টি হয়নি। দ্বিতলের অংশটি সংক্ষিপ্ত নয়। তবে, কোনও গর্ভগৃহ গড়া হয়নি সেখানে।
শীর্ষক বা চুড়াটির গড়ন বেশ মনোরম। বেঁকি, সুদৃশ্য একটি আমলক, কলস, সুদীর্ঘ নিশান-দণ্ড এবং সর্বোপরি বিষ্ণুমন্দির-বাচক সুদর্শন চক্রটি স্থাপিত।
অলঙ্করণের কিছু কাজও আছে মন্দিরে। তিনটি প্রবেশপথের খিলানের মাথার উপরের তিনটি বড় প্রস্থে, কার্ণিশের নীচ বরাবর একটি সমান্তরাল সারিতে এবং দু’দিকের কোণাচ অংশের লাগোয়া দুটি খাড়া সারিতে ফলক বিন্যাস করা হয়েছে। টেরাকোটা এবং স্টাকো-রীতির কাজ। মোটিফ হিসাবে আছে, ভগবান বিষ্ণুর দশাবতার, অশ্বারোহী সৈনিক, জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম, ইত্যাদি। রামায়ণ থেকে রাম-রাজা ফলকটি বেশ বিশদে রচিত হয়েছে— সিংহাসনে উপবিষ্ট রামচন্দ্র এবং সীতাদেবী, দুই দিকে ছত্রধারী ভরত, লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন, বিভীষণ এবং সুগ্রীব। সিংহাসনের নীচে পবন-নন্দন হনুমান উপবিষ্ট।
সেবাইত পরিবার থেকে জানা গিয়েছে, কিছু টেরাকোটা ফলক জীর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণে, বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া থেকে নতুন ফলক এনে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।সাক্ষাৎকারঃ সর্বশ্রী শক্তিপদ সরকার, মতিলাল সরকার, গণপতি সরকার—কাতরাবালি।
সহযোগিতাঃ শ্রী সদানন্দ সরকার এবং মেদিনীপুর ছাত্র সমাজ—মেদিনীপুর শহর।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর কিংবা ঘাটাল থেকে আরামবাগ-বর্ধমান মুখী পথের শ্রীনগর পৌঁছে, ১০ কিমি পশ্চিমে কাতরাবালি গ্রাম।