নিজস্ব সংবাদদাতা: গরমের ছুটি একদিন শেষ হবে। পড়ুয়ারা ফের স্কুলে যাবেন। ফের পঠনপাঠন শুরু হবে। শিক্ষক শিক্ষিকারা আবারও স্কুলে গিয়ে পড়াবেন ছেলেমেয়েদের। খালি কোচবিহারের মেখলিগঞ্জের ইন্দিরা বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিকা অঙ্কিতা অধিকারীর আপাততঃ স্কুল যাওয়া হবেনা। আদালত অবশ্য এখনও তেমন কোনও রায় দেয়নি কিন্তু কোন লজ্জায় ছাত্রছাত্রীদের আর নিজের সহকর্মীদের কাছে গিয়ে দাঁড়াবেন তিনি।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/05/IMG_20220519_170844-1.jpg)
গোটা রাজ্যের পাশাপাশি ইন্দিরা বিদ্যালয়ও যে জেনে গেছে এসএসসি তে ফেল করা দিদিমণি তিনি! না লজ্জা তাঁর একার নয়, লজ্জাতো তাঁর মন্ত্রী পিতারও! ক্ষমতার জেরে বেনিয়মের পথে ফেল করা মেয়েকে শিক্ষিকা বানিয়ে দিয়েছেন! কিন্তু কে জানত এ সব যদি না শিলিগুড়ির কোর্ট মোড়ের গৃহবধূ শেষ অবধি লড়াইটা জারি রাখতেন?
শিলিগুড়ি জুড়ে তাই একটাই চর্চা, একজনেরই চর্চা। তাঁর নাম ববিতা সরকার। গত ৫ বছর ধরে কখনও ছোট দুটি সন্তানকে নিয়ে আবার কখনও তাদের বাড়িতে রেখেই ছুটে গেছেন শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা, এসএসসি অফিস থেকে হাইকোর্ট। প্রশ্ন তুলেছেন, কোন জাদু বলে তিনি মেধা তালিকার ২০ নম্বর থেকে ২১ নম্বরে নেমে গেলেন আর কে তিনি যাঁর নামই ছিলনা মেধা তালিকায় সে হঠাৎ করে তালিকার ১নম্বরে চলে গেল।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/05/FB_IMG_1652970518427.jpg)
ববিতা যেমন ২০ থেকে ২১ নম্বরে নেমে গেছিলেন তেমনই তার আগে থাকা ১৯ জনও তো পরের তালিকায় একধাপ করে নীচে নেমে গেছিলেন, কই তাঁরা তো এই প্রশ্ন তোলেননি? এখানেই ববিতা বাকিদের থেকে আলাদা। আর তাঁর এই প্রশ্ন তোলার কারণেই দুধ কে দুধ, পানি কে পানি হয়ে গেল।
শিলিগুড়ির কোর্ট মোড়ের মেয়ে ববিতা সরকার যদি প্রশ্নটা না তুলতেন তাহলে তো জানাই যেতনা হাজার হাজার ছেলে মেয়ের জীবন যৌবন শেষ করে দিয়ে দুর্নীতির সিঁড়ি বেয়ে কী ভাবে এসএসসি-র যে মেধাতালিকার শীর্ষে উঠে যান মন্ত্রীকন্যা থেকে শাসকদলের ক্যাডাররা কিংবা অর্ধলাখ ঘুষ দেওয়া ফেল করা গাধার দল। আর বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করেও সেই তালিকা থেকে ছিটকে যান ববিতার মত যুবক যুবতীরা। ভাবা যায়? মন্ত্রীকন্যা অঙ্কিতা অধিকারীর চেয়ে ১৬ নম্বর বেশি পেয়েছিলেন।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/05/FB_IMG_1652970536110.jpg)
তবু ববিতার নাম তালিকার ২১ নম্বরে ছিল। আর পরেশের মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর নাম ছিল মেধা তালিকার শীর্ষে। শুধু তাই নয়, তার চেয়েও বড় কথা ইন্টারভিউ বা পার্সোনালিটি পরীক্ষাই দেননি মন্ত্রী কন্যা। এখন দেখা যাচ্ছে ৩১ অগাস্ট, ২০১৮-য় এসএসসির সুপারিশপত্রের ভিত্তিতে অঙ্কিতার চাকরি। SSC’র চেয়ারম্যান জানান, অঙ্কিতা অধিকারী ৬১ নম্বর পেয়েছেন, অ্যাকাডেমিকে ৩১, বিষয়ভিত্তিক ৩০। আর মামলাকারী ববিতা সরকার মোট ৭৭ নম্বর পেয়েছেন। অ্যাকাডেমিক ৩৩, বিষয়ভিত্তিক ৩৬ এবং পার্সোনালিটি টেস্টে ৮। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এসএসসির চেয়ারম্যানকে প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে কি ধরে নিতে পারি অঙ্কিতা পার্সোনালিটি টেস্টে অংশ নেননি?’ হাইকোর্টের প্রশ্নের মুখে স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান জানান, ‘হতেই পারে তিনি পার্সোনালিটি টেস্টে অংশগ্রহণ করেননি।’
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/05/IMG_20220519_205848.jpg)
ববিতা ২০১৬ সালে স্কুলশিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় বসেন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর মেধাতালিকা প্রকাশ হয়েছিল। সেই তালিকায় অবশ্য ববিতার নাম প্রথম ২০তেই ছিল। কিন্তু সেই তালিকা বাতিল করে দেয় এসএসসি। কিছু দিন পর প্রকাশিত হয় নতুন তালিকা। নতুন তালিকায় ববিতার নাম ছিল ওয়েটিং লিস্টে। আর পুরনো তালিকায় কোথাও না থাকা অঙ্কিতার নাম নতুন সংযোজন! ততদিনে অঙ্কিতার বাবা মন্ত্রী পরেশ অধিকারী ফরোয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃনমূল।
শিলিগুড়ির কোর্ট মোড়ের মেয়ে কিন্তু লড়াই ছাড়েননি। তিনি বলছেন, ” গত চার বছর ধরে দৌড়েছি দিনের পর দিন। আমার প্রাপ্ত নম্বর জানতে চেয়ে কমিশনে চিঠি দেই কিন্তু উত্তর পাইনি। আরটিআই করেছি উত্তর মেলেনি। কখনও ২টি ছোট বাচ্চাকে নিয়ে কখনও তাদের ঘরে রেখে ধর্ণা মঞ্চে বসেছি।” কে এই অঙ্কিতা অধিকারী যার জন্য প্যানেল বদলে যায়? তখনও জানতেন না ববিতা। যখন জানতে পারেন যে তিনি এক দোর্দন্ডপ্রতাপ প্রভাবশালী নেতার মেয়ে তখন তাঁর আরও জেদ চেপে যায়। বিপক্ষে যখন ‘প্রভাবশালী’ মন্ত্রী, তখন লড়াই যে কঠিন হবে, তা বুঝেছিলেন ববিতাও। কিন্তু হাল ছাড়েননি। আর সেই হার না মানা মনোভাবই শুধু মন্ত্রী বা তাঁর কন্যা নয়,গোটা সরকারটাকেই উলঙ্গ করে দিল।