শশাঙ্ক প্রধান : ২১বছরের এক যুবতী গৃহবধূকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাকে নিয়ে বর্ধমান চলে গিয়েছিল ৪৪ বছরের এক ব্যক্তি। গ্রাম্য সহজ সরল জীবনের বদলে জৌলুসের জীবনের খোয়াবনামায় ভুলিয়ে বিভিন্ন মহিলাকে এভাবেই তুলে নিয়ে যাওয়া আর স্বপ্ন ভঙ্গের পর তাঁদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। তারপর মর্মান্তিক অবস্থা, না ফিরিয়ে নেয় স্বামী না মান্যতা দেয় সমাজ। হয় আত্মহত্যা নয় দুরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে পরিচয় লুকিয়ে বাঁচা অথবা পতিতাপল্লী। পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং, পিংলা জুড়ে সক্রিয় একটি চক্রের ৩ পান্ডার ১পান্ডাকে চিহ্নিত করে গৃহবধূ সমেত তাকে পাকড়াও করে বর্ধমান থেকে বুধবার তুলে আনে ভারত জাকাত মাঝি পরগনা মহালের সবং ব্লকের কয়েকজন সদস্য। তারপর তাঁদের তুলে দেওয়া সামাজিক মোড়লদের বিচার বিবেচনার জন্য। বৃহস্পতিবার দিনভর সালিসীর পর মোড়লরা নিদান দিয়েছেন চক্রের ওই পান্ডাকে বিয়ে করতে হবে ওই গৃহবধূকে।
জানা গেছে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম লক্ষীকান্ত সিং। বাড়ি পাশের পিংলা থানা এলাকার ধনেশ্বরপুরে। লক্ষীকান্ত শুধু বিবাহিত নয় তাঁর ছেলে মেয়ে এবং নাতি নাতনি রয়েছে। ভারত জাকাত মাঝি পারগনা মহালের সবং মুলুক শাখার পারগানা মাঝি (সবং ব্লক এলাকার প্রধান) মিঠুন মুর্মু জানিয়েছেন, ‘লক্ষীকান্ত সিং এবং তার আরও দুই সাকরেদ সহজসরল আদিবাসী কন্যা বা গৃহবধূদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাঁদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নিজেরা ভোগ করে এবং অর্থের বিনিময়ে অন্যদের ভোগের ব্যবস্থা করে দেয়। হয়ত তারা এরপর স্বপ্নভঙ্গ হওয়া নিরুপায় গৃহহীন মহিলাদের পাচারও করে দেয়। আমরা বহুদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলাম এরপরই এই গৃহবধূর স্বামী আমাদের সমাজের কাছে অভিযোগ জানায় যে তাঁর ২বছরের বিবাহিতা স্ত্রীকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেছে লক্ষীকান্ত।
মিঠুন জানান, এরপরই আমরা ওই ব্যক্তির অবস্থান জানার চেষ্টা করি। আমাদের সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে খোঁজ খবর নিতে নিতে জানতে পারি যে লক্ষীকান্ত সবং থানার বোয়ালিয়া গ্রামের গৃহবধূকে নিয়ে বর্ধমানের একটি জায়গায় অবস্থান করছে। সঙ্গে ওর দুই সাকরেদ রয়েছে। এরপরই বর্ধমান রওনা দেই আমরা। ওখানে ওরা যাতে না পালাতে পারে তাই আমাদের ওখানকার শাখার লোকেরা ওদের নজরদারিতে রাখে। বুধবার সকালেই লক্ষীকান্ত এবং গৃহবধূকে ধরে ফেলা হয়। বাকী ২ ব্যক্তি অবশ্য গা ঢাকা দেয়। রাতেই লক্ষীকান্ত ও গৃহবধূকে নিয়ে আমরা বোয়ালিয়াতে হাজির হই। বৃহস্পতিবার তাদের ২জনকে হাজির করা হয় আমাদের সমাজের পাঁচ এলাকার মোড়লের কাছে। দিনভর আলাপ আলোচনার পর মোড়লরা রায় দিয়েছেন ওই গৃহবধূকে বিয়ে করতে হবে লক্ষীকান্তকে।
জানা গেছে ওই সন্তানহীনা গৃহবধূর স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছেন মোড়লরা। স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে রাজী হননি। এরপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গৃহবধূকে বিয়ে করবে লক্ষীকান্ত। লক্ষীকান্ত কীভাবে তার বর্তমান স্ত্রীকে রাজী করাবেন সেটা তার ব্যাপার কিন্তু বিয়ে করতেই হবে। আদিবাসী সমাজের নিয়ম অনুযায়ী ওই গৃহবধূর স্বামীর জন্য নতুন বধূ খোঁজা হবে। স্বামী নিজেও খুঁজতে পারেন অথবা সমাজ খুঁজবে। সমাজে যেহেতু কন্যাপন প্রচলিত তাই ওই স্বামীর নতুন বিয়ের জন্য যা কন্যাপন লাগবে তা বহন করতে হবে লক্ষীকান্তকেই। এছাড়াও বিয়ের খরচ, সালিসি সভার খরচ, পূজাপাট যাবতীয় দায়িত্ব বহন করতে হবে লক্ষীকান্তকেই। ওই স্বামীর ভবিষ্যতে কোনও ক্ষতির করার চেষ্টাও যেন লক্ষীকান্ত না করে তারজন্য কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে তেমন চেষ্টা হলে কঠিনতম শাস্তির মুখে পড়তে হবে তাঁকে।
বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেনি পুলিশ। পুলিশে কোনও তরফে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। বুধবার রাত থেকেই একটি গাছে বেঁধে রাখা হয় দু’জনকে। মহিলাকে কেন বাঁধা হল এর জবাবে একটি সূত্রে বলা হয়েছে প্রলোভনে পড়ে নিজের স্বামীকে প্রবঞ্চিত করার শাস্তি হিসাবেই এটা করা হয়েছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে সবং থানার পুলিশ গেলে পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া হয়, আদিবাসী সামাজিক প্রথা মেনেই বিচার করা হবে। কোনও পুলিশি হস্তক্ষেপ চায়না সমাজ। সমাজ দুজনকেই সামাজিক বিধিভঙ্গের শাস্তি দেবে কিন্তু সেই শাস্তি আইনকে অগ্রাহ্য করে নয় তাই পুলিশ যেন বিষয়টির মধ্যে না আসে। এরপরই পুলিশ সরে যায়।
মিঠুন মুর্মু জানিয়েছেন, আমাদের মোড়লরা যা রায় দিয়েছেন তা আমাদের সমাজে সর্বজন গ্রাহ্য। এই রায়ের বিরুদ্ধে বাদী বা বিবাদী সমাজের কেউই যেতে পারবেনা। এরপর আমরা বাকি দুই দালালকে খুঁজছি। মহিলাদের প্রলোভন দেখিয়ে মজা করার পরিমান টের পাবে ওরাও। উল্লেখ্য এই সালিসি সভায় মহিলাদেরও অংশগ্রহণ ও মতামত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।