শশাঙ্ক প্রধান : নিজেরই কলেজের এক অধ্যাপক ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষগত আচরণ ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে পুলিশের দ্বারস্থ হলেন এক অধ্যাপিকা। “এসসি এসটি এট্রসিটি (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট”র আওতায় অভিযোগ দায়ের করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। ঘটনাকে ঘিরে যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষামহলে। অভিযোগ পাওয়ার পরই তদন্ত শুরু করেছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং থানার পুলিশ। যদিও বিষয়টিকে ভিত্তিহীন বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কলেজ কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে গত ১৯শে অক্টোবর সবং থানায় করা এক অভিযোগে সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা পাপিয়া মান্ডি অভিযোগ করেছেন যে তিনি জাতিগত পরিচয়ে তফসিলি উপজাতি ভুক্ত হওয়ায় তাঁরই এক সহকর্মী অধ্যাপক ড: নির্মল বেরা তাঁকে প্রায়শই জাতি পরিচয় তুলে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে থাকেন এমন কী ছাত্রছাত্রীদের সামনেও তিনি এই একই ব্যবহার করেন। উদাহরণ স্বরূপ ওই অধ্যাপিকা জানিয়েছেন, একটি অনলাইন ক্লাশ চলার সময় আদিবাসী বলতে কাদের বোঝায় এই প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপিকা পাপিয়া মান্ডি যখন পড়ুয়াদের বলছিলেন যে, আদিবাসী বলতে দেশের প্রাচীনতম অধিবাসীদের বোঝায় তখন সহকর্মী অধ্যাপক নির্মল বেরা ওই অনলাইন ক্লাশেই পড়ুয়াদের উপস্থিতিতেই জানান যে, অধ্যাপিকা পড়ুয়াদের ভুল পড়াচ্ছেন। এরপর অধ্যাপক বেরা ওই অনলাইন ক্লাশেই বলেন যে, যারা গাছে গাছে ঝুলে তারাই আদিবাসী।
অধ্যাপিকা আরও অভিযোগ করেছেন, ‘ ওই অধ্যাপক তাঁকে প্রায়শ:ই খুব সুচারু ও নিপুণ ভাবে মানসিক হেনস্থা করে থাকেন যা একপ্রকার নির্যাতনের সমান। এমন কী তাঁকে দিয়ে স্টাফরুমের জানলা দরজার পর্দার মাপ নেওয়ার জন্য জোর করাও হয়েছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। অধ্যাপিকা আরও জানিয়েছেন, অধ্যাপক বেরার এই জাতি বিদ্বেষ মূলক আচরণের বিষয়টি অধ্যক্ষ ড: তপন কুমার দত্তকে জানানোর পরেও তিনি কোনও ব্যবস্থা নেননি। শুধু তাই নয় অধ্যক্ষ নিজেও এই প্রক্রিয়ায় সামিল রয়েছেন। অধ্যাপিকার অভিযোগ নিয়োগের পর থেকেই তিনি জাতি বিদ্বেষের শিকার এবং বর্তমান অধ্যক্ষর সময়েও তার কোনও অন্যথা হয়নি। তিনি বলেন, ‘আগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ যেমন তাঁকে তাঁর পাওনা ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির পরিবর্তে ৪মাস ছুটি দিয়েছিলেন বর্তমান অধ্যক্ষও তাঁকে তাঁর বকেয়া ছুটি অনুমোদন করেননি আবেদন করার পর।
অধ্যাপিকার বয়ানে বলা হয়েছে কলেজের এক শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর বক্তব্য রাখার পর পড়ুয়ারা যখন করতালি দিচ্ছিলেন তখন অধ্যক্ষ মঞ্চে উঠে তাঁর চেহারা সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক উক্তি করে বলেন, ‘উনি অধ্যাপিকা নন, ওনাকে আমরা ছাত্রী হিসাবেই দেখব।’ এরপরই পড়ুয়ারা হো হো করে হেসে ওঠে। অধ্যাপিকা তাঁর আরও একটি অভিযোগ দায়ের করতে গিয়ে বলেছেন, তাঁর বেতনের বকেয়া প্রাপ্য পেতে অসহযোগিতা করা, শারীরিক অসুস্থতার জন্য ছুটি নিলে সেই ছুটি আরও বাড়তি নিতে বাধ্য করা ইত্যাদি কাজ করেছেন অধ্যক্ষ ড: দত্ত। অভিযোগ পত্রে আরও বলা হয়েছে, অধ্যাপক বেরার জাতিবিদ্বেষ ভাবাপন্ন আচরণের জন্য তিনি অধ্যক্ষের কাছ থেকে টিচার্স কাউন্সিলের সম্পাদক পদে পুরস্কৃত হয়েছেন।
পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করার পর অভিযুক্ত অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ সহ কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে গত বুধবার। সবং থানায় হাজির হয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁদের বক্তব্য রেখেছেন। তাঁদের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হয়েছে, অধ্যাপক বেরা আদিবাসী সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় সরকারি ভাষ্যকেই ব্যক্ত করেছিলেন। অভিযোগকারিণী তার একটি ক্ষুদ্র অংশ সামনে এনে বিষয়টি বিকৃত করছেন। তাছাড়া তারপরও অভিযোগকারিণী আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে দাবি করায় অধ্যাপক বেরা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ আরও দাবি করেছেন ওই অধ্যাপিকাকে ইউজিসি গাইড লাইন মেনেই মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয়েছিল কারন তিনি তাঁর পূর্বেই একদফা ছুটি নিয়ে নিয়েছিলেন। পুলিশ সমস্ত কিছু শোনার পর তদন্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং একজন এসডিপিও পদমর্যাদার আধিকারিক এই তদন্ত করছেন।
এদিকে এই সংক্রান্ত জল গড়িয়েছে আরও অনেকদূর। গত সেপ্টেম্বর মাসেই সারাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক, অধ্যক্ষ, গবেষক মিলিয়ে প্রায় ১৪০জন বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী ‘পাপিয়া মান্ডি’র পাশে দাঁড়ান বলে এক স্বাক্ষরিত পত্র শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে পাঠিয়েছেন। পাশাপাশি দেশ জুড়ে জনমত তৈরিতে নেমেছেন তাঁরা। তাঁরা জানিয়েছেন, ‘কিছুদিন আগে খড়গপুর আইআইটির অনলাইন ক্লাসরুমে শিক্ষকের জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য, বছর দুয়েক আগে রবীন্দ্রভারতীতে চার জন অধ্যাপকের অভিজ্ঞতা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের নিগ্রহ—এসবই একদিকে রাজ্যবাসীর কাছে লজ্জার, এবং অন্যদিকে এক গভীর সমস্যার সূচক। এই প্রকার বিদ্বেষ ও বিভাজনের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের স্পষ্ট অবস্থান সত্ত্বেও এগুলো যেভাবে ঘটে চলেছে তা সংবিধান এবং সরকারি নির্দেশনামারও লঙ্ঘন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও রাজ্যের উচ্চশিক্ষা কাউন্সিল যাতে অধ্যাপক পাপিয়া মাণ্ডির অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে ও দ্রুত তদন্ত করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় সে ব্যাপারে আপনার হস্তক্ষেপের আবেদন জানাচ্ছি।’