শশাঙ্ক প্রধান: পূজায় কাছে দুরে কোথাও বেড়ানোর প্ল্যান করেছেন? কাছের মানুষটির সঙ্গে দুরন্ত একটা সেলফি তোলার প্ল্যান রয়েছে? তবে ঘুরে আসুন পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার পশ্চিমচকে। দেখে আসুন এক সাথে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ১৪টি মন্ডপ। না, এবছর জেলা প্রশাসনের সেরা পুজোর তালিকায় এই ১৪টি মন্ডপের একটিরও ভাগ্যে কোনও পুরস্কার জোটেনি। জোটার কথাও নয় কারন মাটির প্রতিমা নয়, এই মন্ডপে লক্ষ্মী সরস্বতী আর গণেশ কার্তিকদের নিয়ে রয়েছেন জীবন্ত দুর্গার দল। প্রকৃতি নিজের হাতে এদের পুজোর থিম সাজিয়ে দিয়েছে যে থিমের নাম এক কথায়, ব্যর্থতা।
১৫ই সেপ্টেম্বর বিকাল থেকেই ফুলতে শুরু করেছিল চন্ডিয়া নদী। রাতেই বাঁধ ভাঙে পশ্চিমচকের কাছে। হু হু করে জল ঢুকতে শুরু করে। সকালের মধ্যেই সেই জল কোমর ছাড়াতে শুরু করে। বাধ্য হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় উঠে আসতে বাধ্য হয় ৩০/৩৫টি পরিবার। সেই থেকেই থেকে যাওয়া। সহায় সম্বলহীন দুর্গা আর তার ছেলেপুলেদের জন্য সেই মন্ডপ সাজানোর শুরু। স্থানীয় প্রশাসনের কিংবা অন্য কোনও সংস্থার দেওয়া কালো তার্পোলিনের সেই প্যান্ডেলে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয় দুর্গা কিংবা তার ছেলেপুলেদের। প্রথম কয়েকদিন জুটেছে কেবল মুড়ি আর চিড়ে। ইদানিং রাস্তার ধারেই রেশন কিংবা ত্রাণের চাল ফুটিয়ে কোনও রকম খাওয়া দাওয়া। আলো ঝলমল পুজোর প্যান্ডেল এঁদের থেকে অনেকটাই দুরে।
১৪দুর্গার ১ দুর্গার নাম তনুশ্রী বেরা জানালেন, ‘আমাদের ঘরবাড়ি বলতে খুবই সামান্য। ২ কামরার মাটির ঘরে দুই মেয়ে আর স্বামী সমেত চারজনের সংসার। সেই ঘরে জল ঢুকে গেছে। প্রায় ২০দিন জল নামেনি। এখন জল কিছুটা কমলেও ঘরে কাদা থৈথৈ করছে। এই অবস্থায় কোথায় যাব? বাধ্য হয়ে রাস্তায় থাকতে হচ্ছে। এখানেই রান্নাবান্না, এখানেই বাস। আরও কতদিন থাকতে হবে, কবে বাড়ি ফিরতে পারব জানিনা। কয়েকজন রাস্তা থেকে গ্রামে ফিরলেও বাড়ি ঢুকতে পারেনি। তারা গ্রামের ভেতরেই উঁচু জায়গায় এরকমই তার্পোলিনের কুঁড়ে বানিয়ে রয়েছে। সব শেষ হয়ে গেছে আমাদের। কিছুই অবশিষ্ট নেই। খেটে খাওয়া জীবন আমাদের। তিলতিল করে তৈরি করা সংসারের টুকিটাকি সবই শেষ হয়ে গেছে।”
অপর আরেক দুর্গা মিতালি বেরা জানান, ‘শুধু ঘরবাড়ি নয়, মাত্র কাটা পাঁচেক জমি আমাদের। সেই জমির চাষ নষ্ট হয়ে গিয়েছে পুরোপুরি। ফলে বছরের যে দু-তিন মাস ওই জমির ধান থেকে চাল বানিয়ে চলত সেই সম্ভাবনাও শেষ। এখন পুরোপুরি দিন মজুরিই সম্বল। কিন্তু সারা বছর তো আর ১০০ দিনের কাজ মেলেনা। ফলে কী করে চলবে তা ভেবেই পাচ্ছিনা। আমার ২টি ছেলের একটির বয়স ১২, অন্যটির ৫ বছর। নিজেরা না’হয় আধপেটা খেয়ে যাব কিন্তু ওই বাচ্চাগুলোর মুখে কী তুলে দেব। আমাদের এই একটাই উৎসব দুর্গাপূজা কিন্তু ওদের কিছুই কিনে দিতে পারিনি। ওদেরও তো নতুন জামা কাপড় পরতে ইচ্ছা করে।’ দুর্গা উৎসবের ঢাকের মধ্যেও দুর্গার চোখ দিয়ে অবিরল চোখের ধারা গড়িয়ে পড়ে। কচিকাঁচা লক্ষ্মী সরস্বতী বা কার্তিক গণেশ যাতে সেই কান্না দেখতে না পায় তাই মুখ আড়াল করেন রাস্তার দুর্গা।
কী করে চলছে এঁদের? জানতে চাওয়া হলে বেশিরভাগই জানিয়েছেন, সরকারের তরফে ত্রাণ বলতে তেমন কিছুই মেলেনি। এমনকি সরকারি তরফে যে তার্পোলিন বিলি করা হয়েছিল তাঁর বেশিরভাগটাই পেয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত হননি এমন মানুষজন। খাবার দাবারের বেশিরভাগটাই জুগিয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন, বৃহন্নলাদের সংগঠন ইত্যাদিরা। কয়েকজন ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিলি করেছেন। এভাবেই চলছে। কিন্তু ৩৫টি পরিবারের যে পরিবারগুলি রাস্তা থেকে গ্রামে গিয়ে ছাউনি করেছেন তাঁরা আর কোনও রিলিফ পাচ্ছেননা ফলে তাঁদের হয়েছে নতুন বিপদ। তাঁরা বর্তমানে খাবার দাবার পাচ্ছেননা।
জল নামতে শুরু করায় কয়েকজন রাস্তার ছাউনি উঠিয়ে গ্রামের উঁচু জায়গায় ছাউনি ফেলেছে ঠিকই কিন্তু কয়েকজনের বাড়ি ফেরার রাস্তা আপাততঃ বন্ধ হয়ে গেছে। কারন মাটির বাড়ি গুলি দিনের পর দিন জলের মধ্যে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই চারটি বাড়ি ভেঙে পড়েছে। বাকি বাড়িগুলো যেকোনও সময়ে ভেঙে পড়তে পারে। সম্প্রতি রাস্তা ছেড়ে বাড়ির পাশে ছাউনি করে থাকা পূর্নচন্দ্র বেরা জানালেন, ‘ বাড়ির ভেতরে জল নেই কিন্তু কাদা রয়েছে আর মাটির বাড়ির দেওয়ালের ভিত দীর্ঘদিন জলের তলায় থাকতে থাকতে নরম হয়ে পড়েছে। যেকোনও সময় ওপরের অংশের চাপে পুরো বাড়িটাই ভেঙে পড়তে পারে। ফলে ঘরে ঢুকতেই সাহস পাচ্ছিনা।’
স্থানীয় মানুষদের বক্তব্য ২০০৪ ও ২০০৮ সালের পর এই এলাকায় চন্ডিয়ার বাঁধ ভেঙে এই ঘটনা ঘটেছে। দিনের পর দিন নদী বাঁধগুলির সংস্কার না করা কিংবা নামকে ওয়াস্তে সংস্কার করার ফলেই দুর্বল হয়ে পড়েছে নদী বাঁধ। ২০১১ সালে কেলেঘাই-কপালেশ্বরী সংস্কার প্রকল্পে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৬০০কোটি টাকা। সেই ৬০০কোটির সিংহভাগ রাজ্য দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেই টাকা খরচ তো করেছে রাজ্যই। রাজ্যের সেচ দপ্তর সহ বিভিন্ন আধিকারিকরা দায়িত্বেই তো সেই কাজ হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন যে প্রতিবছর সেচ বাঁধ সংস্কার হলেও বাঁধ ভাঙে কেন? উত্তরটা পশ্চিমচক থেকেই পাওয়া যেতে পারে।
পশ্চিমচকের দুর্গাদের দুর্গতির শেষ নেই। সে তাঁরা রাস্তা অথবা গ্রামে যেখানেই ছাউনি করে থাকুন। বালিচক থেকে পটাশপুর যাওয়ার রাস্তায় মুন্ডুমারী থেকে ১৪কিলোমিটার গেলেই পশ্চিমচক। খড়গপুর থেকে জামনা হয়েও যাওয়া যায়। পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না পিংলা রাজ্য সড়ক ধরেও আসতে পারেন। যদি সত্যিই সম্ভব হয় একবার ঘুরে আসুন, দেখে আসুন দুর্গা আর তাঁর ছেলেপুলেদের সংসার। করে আসতে পারেন সত্যিকারের দুর্গাপুজো।