Saturday, July 27, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১২৩    চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল—১২৩
চিন্ময় দাশ

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

ব্রজকিশোর মন্দির, কৈনাড়া (পটাশপুর)

ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কাল। গৌড় দখল করে, ওডিশার দিকে নজর দিয়েছেন পাঠান শাসক সুলেমান কররানি। এদিকে, সম্রাট আকবরের সাথে চুক্তি করে, কলিঙ্গরাজ মুকুন্দদেব কররানির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছেন।
সেসময় সম্রাটের দরবারে উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন, আদিতে ওডিশার অধিবাসী, জনৈক কালু মুরারী মোহন দাস মহাপাত্র। যুদ্ধযাত্রায় কলিঙ্গরাজকে সাহায্য করবেন– এই শর্তে ওডিশা-বাংলা সীমান্তে মেদিনীপুর চাকলা (পরবর্তীকালের জেলা)র ভোগরাই এবং পটাশপুর—দুটি পগণার জমিদারী সনন্দ নিয়ে, বাংলায় চলে এসেছিলেন কালু মুরারী।


প্রথমে পটাশপুর পরগণার খাড় গ্রামে মাটির প্রাসাদ গড়ে, বসত করেন তিনি। পরে রাজধানি উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ঐ পরগণারই পঁচেটগড়ে। গড় হাভেলী নির্মাণের সময়, উঁচু প্রাচীরে ঘিরে, পাঁচটি শিব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই পঞ্চ-ইষ্ট থেকে, গড়খাই দিয়ে ঘেরা, নতুন গড়ে তোলা জনপদের নাম হয়েছিল—পঁচেটগড়। দক্ষ হাতে জমিদারী পরিচালনার সুবাদে, ‘চৌধুরী’ খেতাব পেয়েছিল এই রাজবংশ।


রাজবংশটির তৃতীয় পুরুষে পৌঁছে, পরিবার বিভাজন এবং পৃথকভাবে নতুন নতুন বংশ এবং বাসস্থান পত্তনের সূচনা হয়েছিল। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের পদধুলি ধন্য এই এলাকা। এই পথেই পুরীধামে গিয়েছিলেন মহাপ্রভু। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের গভীর প্রভাব সারা এলাকা জুড়ে। যে শরিক নতুন এলাকায় যেখানে উঠে গিয়েছেন, প্রত্যেকেই একটি করে মন্দির স্থাপন করেছেন। শালগ্রাম কিংবা রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে, বৈষ্ণবীয় রীতিতে সেবাপূজার প্রচলন করেছেন সকলেই।
কালা মুরারীর কনিষ্ঠ প্রপৌত্র কৃষ্ণ চরণ দাস মহাপাত্র পঁচেটগড় থেকে অদূরের কৈনাড়া গ্রামে উঠে এসেছিলেন। নিজের পরিবারে ‘ব্রজকিশোর’ নামে কৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে, সেবাপূজার প্রচলন করেছিলেন তিনি।

কৃষ্ণ চরণের দেবতা প্রতিষ্ঠার পর, প্রায় দু’শ বছর ধরে, একটি অস্থায়ী মন্দিরে দেবতা পূজিত হয়েছেন। তাঁর বংশের অষ্টম পুরুষের কর্তা, সাহেবরাম দাস মহাপাত্র, কুলদেবতার জন্য স্থায়ী মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন।
মুখ্য দেবতা ব্রজকিশোরজীউর সাথে, শ্যামরাইজীউ, রাধামাধবজীউ এবং একটি নারায়ণ শিলাও মন্দিরে পূজিত হন। এছাড়া আছে গৌরাঙ্গ এবং নিত্যানন্দের পূর্ণাবয়ব দারুবিগ্রহ। নিত্যপূজা ছাড়াও, বারো মাসে তেরো পার্বণে আয়োজন হয় মন্দিরে  । কলিঙ্গ প্রভাবে শিখর দেউল রীতিতে নির্মিত হয়েছে মন্দিরটি। মূল মন্দির বা বিমান, মাঝখানে সংক্ষিপ্ত একটি অন্তরাল এবং সামনে জগমোহন—তিনটি সৌধ নিয়ে দেবালয়টির গড়ন। উঁচু পাদপীঠের উপর ইটের তৈরি মন্দিরটি পূর্বমুখী। প্রশস্ত একটি প্রদক্ষিণ-পথ মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে।
জগমোহনে চার দিকে খিলান-রীতির চারটি দ্বারপথ। পশ্চিমের দ্বারটি অন্তরাল অংশের সাথে যুক্ত। গর্ভগৃহটি এক-দ্বারী। জগমোহনটি আট-চালা রীতির। তবে, চালাগুলির ছাউনির প্রান্তদেশের বঙ্কিমভাব অল্প। সিলিং হয়েছে চার দেওয়ালে চারটি অর্ধ-খিলান নির্মাণ করে।
বিমান সৌধটি শিখর-রীতিতে নির্মিত।

দেওয়ালগুলিতে বাঢ়, বরণ্ড ও গণ্ডী জুড়ে পঞ্চ-রথ বিন্যাস করা—মাঝখানে প্রশস্ত রাহাপাগ, দুই কোণে দুটি কণকপগ, এবং এই দুইয়ের অন্তর্বর্তী দুটি অনর্থপগ। গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে সিলিং গড়া হয়েছে চারটি খিলানের মাথায় গম্বুজ রচনা করে।
দুটি সৌধেরই শীর্ষক বা চুড়া দুটির গড়ন বেশ মনোরম—বেঁকি, আমলক, তিন-চারটি করে কলস এবং বিষ্ণুচক্র শোভিত।
অল্প কিছু অলঙ্করণ আছে মন্দিরে। জগমোহনের প্রথম ও দ্বিতলের দেওয়ালে। ব্যাদিত-বদন দুটি সিংহমূর্তি, রাধা-কৃষ্ণ, প্রস্ফুটিত পদ্ম ও দুটি ময়ূর, গোপালক কৃষ্ণ, গোপিনীদের বস্ত্রহরণ ইত্যাদি। সবই বা-রিলিফ-রীতির পঙ্খের কাজ।
সেবাইতবংশের সযত্ন পরিচর্যার ছাপ মন্দিরটির সর্বাঙ্গ জুড়ে। তার সিংহভাগ কৃতিত্ব এই বংশের দেবীপ্রসাদ এবং শ্যামাপ্রসাদ—দুই সহোদরের বলে জানা যায়। একটি জীর্ণ মন্দিরকে রক্ষা করেছেন, এটি বড় কম কথা নয়।
সাক্ষাৎকারঃ দেবীপ্রসাদ দাস মহাপাত্র, শ্যামা প্রসাদ দাস মহাপাত্র– বক্সিবাজার, মেদিনীপুর শহর। ডা ভবানী প্রসাদ দাস মহাপাত্র—খাড় বাজার, পটাশপুর। হরিশচন্দ্র পণ্ডা, পুরোহিত—খাড়।
পথ-নির্দেশঃ মেদিনীপুর কাঁথি রাস্তায় এগরা হয়ে খাড়বাজার। এছাড়া, ডেবরা কিংবা মেচেদা থেকে এগরামুখী পথে খাড় বাজার পৌঁছে, পূর্বমুখে ২ কিমি দূরে কৈনাড়া।

- Advertisement -
Latest news
Related news