Saturday, July 27, 2024

Temple tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-১১৯।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল                                                          চিন্ময় দাশগোপালজীউ মন্দির, মীর্জাপুর (পটাশপুর)
মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ থেকে মাঝামাঝি এলাকা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায়, বেশ কয়েকটি বনেদি বংশের অবস্থান আছে। এই পরিবারগুলি আদিতে বাংলার স্থায়ী অধিবাসী নয়। এমনকি, দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত, দীর্ঘ সাড়ে চারশ’ বছর মেদিনীপুর জেলায় ওডিশার রাজাদের শাসনকালে, ওডিশা থেকে চলে আসা পরিবারও নয় তাঁররা। এই পরিবারগুলি এসেছিল অখন্ড ভারতের একেবারে উত্তর-পশ্চিম এলাকা থেকে।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

এঁরা জাতিতে ক্ষত্রীয়, শোলাঙ্কি সম্প্রদায়ভুক্ত। স্থায়ী বসবাস ছিল গুজরাত আর রাজস্থানে। আলাউদ্দিন খিলজী দিল্লি দখলের পর, বারংবার রাজপুতানা এলাকা আক্রমণ শুরু করলে, ধন, প্রাণ আর স্বধর্ম রক্ষার তাগিদে, বহু শোলাঙ্কি অধিবাসী, তীর্থ-পরিক্রমার নামে, স্বভূমি ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের কিছু কিছু অংশ, পুরীধামে জগন্নাথ দর্শন সেরে, প্ৰতিবেশী রাজ্য বাংলার মেদিনীপুর জেলায় উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁদেরই বিভিন্ন শাখা স্থায়ী অধিবাসী হিসাবে, এই জেলার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করেন।
এমনই একটি শাখা প্রথমে খড়্গপুর থানার বীরসিংহপুর এবং চাঙ্গুয়াল গ্রামে থাকালীন গৌড়ের নবাব ইলিয়াস শাহের আক্রমনের শিকার হয়। সেসময় ঘনশ্যাম দেবসিংহের নেতৃত্বে, একটি অংশ নিজেদের রক্তবর্ণ উপবীত অগ্নিকুন্ডে আহুতি দিয়ে, প্রথমে কেশিয়াড়ি থানা, পরে দাঁতন থানার সাবড়া গ্রামে এসে থিতু হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, সুলেমান কররানির সেনাপতি কালাপাহাড়ের আক্রমণে, বংশের কর্তা রামচন্দ্র দেবসিংহ নিহত হলে, পুণরায় তাঁরা পটাশপুর থানায় গিয়ে বসতি গেড়েছিলেন। নতুন করে গড়ে ওঠা জনপদটির নাম হয়েছিল নয়াপুর। পরে, লোকমুখে উচ্চারিত হতে হতে সেটি নৈপুর হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে। রাজপুতানা এলাকায় শোলাঙ্কিরা শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতেন। নৈপুরগড়েও মদনমোহনজীউর নামে বড় আকারের একটি মন্দির গড়া হয়েছিল।

নৈপুরগড়ে থাকালীন বংশবৃদ্ধি হতে থাকলে, কয়েকজন জ্ঞাতিভাই নৈপুর থেকে উঠে গিয়ে, মাধবপুর, হরিদাসপুর, মধুপুর, মির্জাপুর ইত্যাদি গ্রামে গিয়ে নতুন বসত গড়েছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রত্যেকেই তাঁরা একটি করে মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেছিলে নতুন বাসস্থানের সাথে।
বর্তমান আলোচ্য মির্জাপুর গ্রামে প্রথম যিনি উঠে এসেছিলে, তাঁর নামটি পাওয়া যায়নি সেবায়েত পরিবার থেকে। তাঁরা কেবল উর্ধতন ৬ পুরুষের বিবরণ দিতে পেরেছেন।তার মধ্যে উর্ধতন দুটি নাম– বেচারাম দাস (সাড়ে ৮ আনা অংশ) এবং সীতানাথ দাস (সাড়ে ৭ আনা অংশ)। এই দুজনের বংশধরগণই দেবতার সেবাপূজা করে চলেছেন।

দিনে রাতে দু’বার নিত্যপূজার আয়োজন হয় অন্নভোগের নৈবেদ্য সাজিয়ে। সাথে ঘিয়ে প্রস্তুত অন্তত তিনটি ব্যঞ্জন। পরমান্ন রাখতেই হয় দিনের ভোগের সাথে। সম্বৎসরে কয়েকটি বিশেষ উৎসবেরও আয়োজন হয়। তবে পূর্বকালের আড়ম্বর বা জৌলুষ কিছুই আর ধরে রাখা যায়নি।
মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় পুরোহিত, পুঁথিপাঠক, মালাকার, নাপিত, কুমোর, টহলিয়া ইত্যাদি কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল মন্দিরে। একজন পুরোহিত ছাড়া, অন্যেরা আজ আর কেউ যুক্ত নাই।

এবার আমরা মন্দিরের স্থাপত্য-রীতির সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলে নিই। ইটের তৈরী দক্ষিণমুখী মন্দিরটি শিখর-শৈলীতে নির্মিত। সামনে একটি চলা-রীতির জগমোহন। পিছনে দেউল-রীতির বিমান বা মূল মন্দির।

মূলমন্দিরটি সম্পূর্ণ বর্গাকার, সামনের জগমোহন আয়তাকাররের। জগমোহনের চার দিকের দেওয়ালে খিলান-রীতির চারটি দ্বারপথ। পিছনের দ্বারটি গর্ভগৃহের সাথে যুক্ত। শিখর মন্দিরে সাধারণভাবে বিমান এবং জগমোহনের মাঝখানে ক্ষুদ্র একটি অন্তরাল নির্মিত থাকে। এই মন্দিরে সেটি নাই। জগমোহনের পিছনের দেওয়ালটি বিমানের সামনের দেওয়ালে অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে। জগমোহনের ছাউনির চালগুলির প্রান্তদেশের বঙ্কিম ভাবটি বেশ মনোরম।

সাধারণভাবে অধিকাংশ শিখর-রীতির বিমানের চারদিকের দেওয়ালে কলিঙ্গ প্রভাবে রথ-বিন্যাস করা হয়ে থাকে। এখানেও সেই ভাবে দেওয়ালের বাঢ় অংশে নব-রথ এবং গন্ডী অংশে সপ্ত-রথ বিন্যাস করা। বিমান এবং জগমোহন দুটি সৌধেই, শীর্ষক অংশে বেঁকি, ঘন্টা, আমলক, কলস বিষ্ণুচক্র রচিত ছিল। তবে এখন ভারী জীর্ণ দশা। দুটি জীর্ণ আমলক ছাড়া,কিছুই টিকে নাই আর।
চোখ আটকে যাওয়ার মত, একটি বৈশিষ্ট আছে এই মন্দিরে।

বিমানের চার দিকের দেওয়ালে, গন্ডী অংশের রাহার উপর, চারটি ‘প্রতিকৃতি দেউল’ নির্মিত হয়েছে। মাথায় বেঁকি, ঘন্টা, আমলক, কলস, বিষ্ণুচক্র– সবই বিদ্যমান। বা-রিলিফ রীতির কাজ এগুলি। এটি বেশ বিরল নিদর্শন।
টেরাকোটা ফলকে অলংকরণ করা হয়েছিল মন্দিরে। মুখ্যত জগমোহনের তিনটি দেওয়ালেই ফলকগুলি যুক্ত। ফলকের মোটিফ নির্বাচিত হয়েছে– মুখ্যত রামায়ণ, পুরাণকথা থেকে। সামাজিক বিষয় নির্ভর ফলকও আছে কয়েকটি। বাদক-বাদিকা, দ্বারপাল, সাধু-মোহান্ত ইত্যাদির মূর্তিও আছে।

সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী অমরেন্দ্র নাথ দাস, তাপস কুমার দাস, কালীশঙ্কর দাস– মীর্জাপুর।
সহযোগিতা : শ্রী তাপস কুমার দাস– মতিরামপুর, পটাশপুর।
পথ-নির্দেশ : ১. মেচেদা-দিঘা রুটের বাজকুল, মেদিনীপুর-দিঘা রুটের এগরা– দু’দিক থেকেই পটাশপুর পৌঁছে, বালিচকগামী পথে নৈপুর লক্ষ্মী বাজার। কিংবা, ৬ নং জাতীয় সড়ক মুম্বাই রোডের বালিচক থেকে লক্ষ্মী বাজার। এবার সেখান থেকে ২ কিমি দক্ষিণে মীর্জাপুর গ্রাম।

- Advertisement -
Latest news
Related news