Saturday, July 27, 2024

Temple Tell : জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ১১৮ ।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল                                                             চিন্ময় দাশবিলেশ্বর শিব মন্দির, ধামতোড় (ডেবরা)
শ’দুই বছর আগের একটি ঘটনা। এক গৃহস্থ তাঁর খেতে হলুদ তোলার সময়, একটি পাথরখণ্ড পেয়েছিলেন মাটির তলা থেকে। কালো রঙের গোলাকার পাথর। গ্রামস্থ পঞ্চজনা বসে পরামর্শ করেছিলেন। মহাদেব শিবের লিঙ্গবিগ্রহ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল পাথরটিকে। প্রগাঢ় ভক্তিতে সেবাপূজার প্রচলন করেছিলেন গ্রামবাসীরা। দেবতার নাম হয়েছিল—বিল্লেশ্বর মহাদেব।
দ্রুত বেড়ে চলেছিল দেবতার মহিমা আর প্রভাব মণ্ডল। ধামতোড় গ্রামের দেবতার পূজার্চনায় যোগ দিতে, এক এক করে এগিয়ে এসেছিল কাছের দূরের গ্রামগুলি। একসময় বাইশটি গ্রামের ঠাকুর হয়ে উঠেছিলেন বিল্লেশ্বর জীউ। একেবারে প্রতিষ্ঠার দিন থেকে, আজও ‘দেশ ষোল আনা’ কমিটির তদারকিতেই মন্দিরের পরিচালনা হয়ে আসছে।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

এই কমিটিতে একজন সভাপতি, একজন সম্পাদক এবং একজন হিসাবরক্ষক আছেন। প্রতি ৫ বছরে কমিটির পুণর্গঠন করা হয়। এছাড়া, সবার উপরে রয়েছেন ‘গ্রাম মুখ্যা’। তিনি এবং ‘দেশ ব্রাহ্মণ’ও পরিচালনার কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকেন।
এ সকল সংবাদ জানা যায়, গ্রামবাসীদের বয়ান থেকেই। কিন্তু, বিল্লেশ্বরের জন্য সুদর্শন এই মন্দিরটি কোন জমিদার গড়ে দিয়েছিলেন, সে সংবাদটি লেখা নাই কারও স্মৃতিতে। শুধু মন্দির গড়া নয়, পুরোহিতের জন্য জায়গীর সম্পত্তিও দিয়ে গিয়েছিলেন সেই ধর্মপ্রাণ মানুষটি। তাঁর নামটি এখন আর জানা যায় না।

নিত্যপূজা আর ভক্তজনের পূজার বাইরে, সম্বৎসরে দুটি বড় পূজা এখানে– মাঘ-ফাল্গুনের শিব চতুর্দশী, আর চৈত্র শেষের গাজন।
গাজন হোল শ্মশানবাসী মহাদেবের সাথে, পাতালপুরীর অধীশ্বর ময় দানবের সুন্দরী কন্যা, কামিন্যা দেবীর বিবাহের প্রতীক উৎসব। উৎসবটি মহা আড়ম্বরে আয়োজিত হয় এই মন্দিরে। ৭ ভোগের গাজন, টানা ৯ দিন ধরে চলে উৎসবটি।
পাটভক্তা, দেউলভক্তা ও ভাণ্ডারঘরিয়া নামের ৩ জন ভক্তা এবং ১৬ জন বাস্তুভক্তা অনুষ্ঠানে যুক্ত থাকেন। ধর্মপ্রাণ গ্রামবাসীগণই ভক্তাদের খরচ বহন করেন। মানতের ভক্তাগণও এসে অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

গাজনের সময় প্রায় দু’সপ্তাহ ব্যাপী একটি মেলার আয়োজন করা হয়। ‘চড়ক মেলা’ নামেই মেলাটির পরিচয় এবং এলাকা জোড়া খ্যাতি। মেলা উপলক্ষে একজন সম্পাদক-এর দায়িত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিই অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে।

ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রতিটি পরিবারেই সেসময় আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন-সুজনের সমাগমে কল্লোলিত হয়ে ওঠে পরিবারগুলি। হবে না-ই বা কেন? মহাদেব বিল্লেশ্বর জীউ যে গ্রামবাসীদের প্রাণের দেবতা, বড় আপনজন!
মহাদেবের সুদর্শন মন্দিরটির দিকে চোখ ফেরানো যাক একবার। ইটের তৈরি রত্ন-রীতির মন্দির। কেন্দ্রীয় রত্নে ত্রিরথ বিন্যাস এবং মাথায় পীঢ়-ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু কোণের রত্নগুলি একটু ভিন্নরীতির। রথবিন্যাস নাই। চারটি রত্নই নির্মিত হয়েছে অক্টাগোনাল বা আট-কোণা রীতিতে। পাঁচটি রত্নেরই শীর্ষক অংশ বেশ মনোরম দর্শন।
পশ্চিমমুখী এই মন্দিরে দক্ষিণেও একটি দ্বার আছে। পরবর্তীকালে, সংস্কার কাজের সময়, দক্ষিণ-দ্বারের লাগোয়া করে একটি ভোগশাল নির্মিত হয়েছে। মাথার ছাউনিটি লক্ষ্য করবার মত। উপরের অংশ হস্তি পৃষ্ঠের মত উত্তলাকার। ভিতরর সিলিং ‘টানা-খিলান’ রীতিতে রচিত হয়েছে।
গর্ভগৃহের সিলিং গড়া হয়েছে চারদিকে চারটি খিলানের মাথায় চতুষ্কোণ ভল্ট স্থাপন করে।
পূর্বে টেরাকোটার কিছু ফলক ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু বর্তমানে গৌরীপট্ট এবং নন্দী মূর্তিটি ছাড়া, মন্দিরে কোনও অলঙ্করণ নাই।

তবে, খোদাই কাজের চিহ্ন যুক্ত, মাকড়া পাথরের একটি ভাঙ্গা অংশ সযত্নে মন্দির প্রাঙ্গণে রাখা আছে। পুকুর খোঁড়ার সময় পাওয়া গিয়েছিল এই প্রত্নবস্তুটি। ‘সূর্য- স্তম্ভ’ নামে পূজা করা হয় এটির। হয়তো কালাপাহাড়, বর্গী বাহিনী কিংবা অন্য কোনও ভিনধর্মী শক্তির আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল গ্রামের কোনও প্রাচীন মন্দির। এই পাথর খণ্ডটিকে তারই চিহ্ন বলে অনুমান করা হয়।
স্বপ্ন দিয়ে তৈরি এ গ্রাম, স্মৃতি দিয়ে গড়া। ধামতোড় গ্রামের সাথে জড়িয়ে আছে ক্ষিরাই খাল নামের যে জলধারা, সেটি আজ তার অতীত গরিমা হারিয়ে অবজ্ঞাত।

পূর্বকালে প্রতি রবিবার জমজমাট হাট বসত এই শিবতলায়। সেই হাটও সরে গিয়েছে খানিক তফাতে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ‘আগষ্ট আন্দোলন’-এর আগুনঝরা দিনগুলির কথা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে মানুষের স্মৃতি থেকে। সেদিনের বিদ্রোহী স্বনামধন্য ডাক্তার মোহিনী পতি, তাঁর পত্নী রেণুকা পতি, প্রকাশ চন্দ্র পতি, বিনোদ কুমার ভূঁইয়া এবং নিরঞ্জন ভূঁইয়া– দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য হাসিমুখে অত্যাচার সয়েছিলেন। সে কাহিনীও হয়তো অনেকেরই মনে নাই আজ।

দু’দুটি জমিদার বাড়ি ছিল এই গ্রামে– ভূঁইয়া এবং শাসমল বাড়ি। একদিন সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করেছে যে পরিবারগুলি, আজ গরিমা বলতে তেমন কিছুই আর নাই তাঁদের।
এই নাই-এর তালিকা এখানে অনেক বড়। সত্যিই নাই, অনেক কিছুই নাই আজ। কিন্তু অনেক কিছু হারিয়েও, নিঃস্ব নয় ধামতোড় গ্রাম। সাত রাজার ধন, এক মাণিক আছে এই গ্রামের। তিনি মহাদেব বিল্লেশ্বর শিব। গ্রামবাসীগণ বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন তাঁদের প্রাণের ঠাকুরকে। আগলে রেখেছেন মহাদেবের আবাস, মনোহর দর্শন শিবালয়টিকেও।

সাক্ষাৎকারঃ  সর্ব শ্রী সুনীল ভূঁইয়া, সুদর্শন ভূঁইয়া, অমিয় কুমার ভূঁইয়া, ভবানী প্রসাদ পতি, অতুল চন্দ্র দোলই, সুব্রত ভূঁইয়া, সুদাম ভূঁইয়া, সুনীল সামন্ত, চিত্ত সামন্ত, সুকুমার শাসমল, অনন্ত সিং এবং ঝন্টু দোলই।
সহযোগিতাঃ শ্রী অনুপ কুমার পতি– ধামতোড়।
পথনির্দেশঃ  মুম্বাই রোডের পাঁশকুড়া এবং ডেবরার মাঝে ধামতোড়। রাজপথের খানিক উত্তরে, মন্দিরটি অবস্থিত।

- Advertisement -
Latest news
Related news