Saturday, July 27, 2024

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ১১৭।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল
শ্রীধর মন্দির, ধামতোড়-ভূঁঞাবাড়ি                (থানা– ডেবরা, মেদিনীপুর)
                                                     চিন্ময় দাশ

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

প্রাচীন কটক রোড-এর উপর অবস্থিত গ্রাম ধামতোড়। পরগণা সাহাপুর। কংসাবতীর জলপথটিও বেশি দূরে নয় গ্রাম থেকে। স্থলপথ এবং জলপথ– দুই পরিবহনের সুবিধা ছিল এলাকাটির। উর্বর কৃষিভূমির সুবাদে, পূর্বকাল থেকে এই এলাকা ছিল কৃষিজ পণ্যে সমৃদ্ধ। পরবর্তীকালে তার সাথে যুক্ত হয়েছিল রেশম উৎপাদন। এক সময় এই দুই থেকে বহু পরিবার অর্থসম্পন্ন হয়ে উঠতে পেরেছিল এই এলাকায়।
এলাকাটি সেসময় ছিল কাশীজোড়ার রাজা রায়বংশের অধীনস্থ। এই বংশের অধীনে ইজারাদার, পত্তনীদার, দর-পত্তনীদার ইত্যাদি নানা নামের, নানা মাপের বেশ কিছু জমিদার নিযুক্ত ছিল। নজরে পড়বার বিষয় হল, এক ধামতোড় গ্রামেই ছিল কয়েকটি জমিদারবাড়ি। তাঁদেরই ভিতর একজন ছিলেন– শ্রী নবকিশোর ভূঞা।

জমিদার নবকিশোরের তিন পুত্র– টিকারাম, পীতাম্বর এবং বৈকুন্ঠ। চৈতন্যদেবের প্রেমধর্মে মজে, মধ্যম পুত্র টিকারাম, নিজের বংশে বৈষ্ণবীয় আচারে দেবার্চনা প্রচলন করেন। ভূঁঞাবংশের বাস্তুর ভিতর ভগবান বিষ্ণুর জন্য একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।

একটি প্রতিষ্ঠালিপি আছে মন্দিরের সামনের দেওয়ালে। তার হুবহু পাঠ এরকম– “শ্রী শ্রী সীধর জিউ / পরিচারক শ্রীযুক্ত বাবু পীতাম্বর ভূঞা / শ্রীশশীভূষণ শীল মিস্ত্রী সাং দাসপুর / সন ১৩১৬ সাল ১০ মাঘ সমাপ্ত”। (বানান অপরিবর্তিত) অর্থাৎ ইং ১৯০৯ সালে মন্দিরের নির্মাণ হয়েছে।

পার্শ্বদেবতা হিসাবে লক্ষ্মী এবং গণেশের দুটি পেতলের বিগ্রহ আছে সিংহাসনে। মূল দেবতা হলেন শ্রীধর নামিত একটি শালগ্রাম বা বিষ্ণু শিলা। নিত্য আতপচাল আর ফল-মূল-মিষ্টান্নের নৈবেদ্যে পূজা হয় দেবতার। বিষ্ণু মন্দির– সেকারণে, তার সাথে আছে বারো মাসে তেরো পার্বণের আয়োজন। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর, প্রথম ৫০ বছর রাজকীয় আড়ম্বরে আয়োজন হয়েছে তেরো পার্বনের। কিন্তু জমিদারি উচ্ছেদের পর, সেসকল আড়ম্বর ধীরে ধীরে খসে গিয়েছে আয়োজন থেকে। তবে এখনও শ্রাবণে ঝুলন উৎসব, কার্তিকে রাস উৎসব, ফাল্গুনে চাঁচর ও দোল উৎসব হয় বিশেষ ঘটা করে। এখানে এই মন্দিরে পঞ্চম রাস এবং পঞ্চম দোল।

দেখা যাচ্ছে, মাত্রই ১১২ বছর আয়ু হয়েছে সৌধটির। তবুও মন্দিরটি আমাদের আলোচনায় এসেছে তার স্থাপত্যরীতির জন্য। শিখর দেউল রীতির এই মন্দিরে বাংলা এবং কলিঙ্গ– দুই শৈলীর সমাবেশ দেখা যায়। ফুট দুয়েক উঁচু পাদপীঠের উপর স্থাপিত দক্ষিণমুখী মন্দিরটি ইটের তৈরী। সামনে জগমোহন এবং পিছনে বিমান বা মূলমন্দির নিয়ে গড়া হয়েছে সৌধটি। আয়তাকার জগমোহনের দৈর্ঘ্য ১২ ফুট, প্রস্থ ৬ ফুট। বিমানটি বর্গাকার– দৈর্ঘ্য-প্রস্থ উভয়ই ১১ ফুট, উচ্চতা ৩০ ফুট।

জগমোহনটি বাংলা শৈলীর, মাথায় চালা ছাউনি দেওয়া। সম্পূর্ণ উন্মুক্ত জগমোহনে, সামনে ‘কলাগেছ্যা’ রীতির গুচ্ছ থাম এবং খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ। পূর্ব এবং পশ্চিমেও একই রীতির দুটি দ্বারপথ আছে। পিছনের দেওয়ালটি বিমানের সাথে সম্পৃক্ত। তাতে একটিই দ্বারপথ। সিলিং হয়েছে ‘টানা-খিলান’ করে। বাইরের ছাউনি চালা-রীতির, পূর্বেই বলেছি আমরা। কিন্তু কিন্তু চালগুলির নিচের প্রান্ত সরলরৈখিক। এছাড়া, চালাটির গড়নও ভারী অভিনব। চালের জোড়মুখগুলি হাতির পিঠের মত উত্তল করে নির্মিত। তাছাড়া, প্রথম দর্শনেই মনে হয়, চালটি যেন উপর থেকে আলতো হাতে বসিয়ে দেওয়া। সারা জেলায় শ’পাঁচেক মন্দির সমীক্ষা করেও, এমন নিদর্শন আমরা দেখিনি।

বিমানটি শিখর দেউল রীতিতে নির্মিত। বাঢ়, বরণ্ড এবং গন্ডী– তিন অংশ জুড়ে সপ্তরথ বিভাজন করা। বর্তমানে মাথায় কেবল দুটি আমলক অবশিষ্ট আছে। ঘন্টা, কলস ইত্যাদি বিলুপ্ত।
জগমোহনেও একটি চূড়া ছিল। সেখানেও বর্তমানে দুটি আমলক এবং নিশান-দন্ডটি ছাড়া, কিছুই অবশিষ্ট নাই।

তেমন কোনও অলংকরণ নাই মন্দিরে। জগমোহনের ছাউনির উপর, দুটি ব্যাদিত-বদন সিংহমূর্তি রচিত আছে। বিমানের পূর্বদিকের দেওয়ালে একটি বড় কুলুঙ্গি নির্মাণ করে দুই দেবদেবীর মূর্তি স্থাপিত ছিল। সওয়া একশ’ বছর পূরণ না হতেই, সেই মূর্তিও বিলুপ্ত।
জগমোহনের কার্ণিশে কতকগুলি ছোট খোপকাটা আছে। জানা যায়, টেরাকোটা ফলক বসাবার পূর্বেই মন্দিরের কারিগরের মৃত্যু হওয়ায়, সেকাজ সমাপ্ত হয়নি।

নিবন্ধ শেষ করার পূর্বে, সেই কারিগর সম্পর্কে দু-একটি কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। একসময়, অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে, মেদিনীপুর জেলার সিংহভাগ মন্দির নির্মাতার বসবাস ছিল দাসপুর থানার সদর দাসপুর গ্রামে। ঠাকুরদাস শীল, আনন্দ মিস্ত্রী, সাফল্যরাম চন্দ্র, হরহরি চন্দ্র, শিবনারায়ণ চন্দ্র, গোপাল চন্দ্র দে, শশিভূষণ শীল প্রমুখ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।

ধামতোড় গ্রামের এই মন্দির নির্মাণের পূর্বে, আরও দুটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন শশিভূষণ। ১. ১৯০৫ সালে ঘাটাল থানার খড়ার গ্রামে মাঝিদের মৃত্যুঞ্জয় শিবের আট-চালা মন্দির। ২. ডেবরা থানারই চক বাজিত গ্রামে দে বংশের চাঁদনি-রীতির লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির। ১৯০৮ সালে এটি নির্মাণ শেষ করে, তিনি ধামতোড় এসেছিলেন।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী অলোক ভূঁঞা, ভোলানাথ ভূঁঞা– ধামতোড়।
সহযোগিতা : শ্রী অনুপ কুমার পতি– ধামতোড়।
পথ-নির্দেশ : ৬ নং জাতীয় সড়ক মুম্বাই রোডের উপর, ডেবরার সামান্য পূর্বে, ধামতোড়। সেখানে উত্তরমুখে কয়েক পা দূরেই ভূঁঞাদের এই মন্দির।

- Advertisement -
Latest news
Related news