Saturday, July 27, 2024

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-১১৬ ।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল
খড়গেশ্বর শিব মন্দির, কদমকুণ্ডু (ক্ষীরপাই শহর, পশ্চিম মেদিনীপুর )
চিন্ময় দাশ                                                             শীলাবতি, রূপনারায়ণ, কেঠিয়া, কুবাই, বুড়িগাং, আমোদর ইত্যাদি ছোট-বড় অনেকগুলি নদীর জলধারায় পুষ্ট ঘাটাল মহকুমা। নদীগুলির অববাহিকা এলাকা জুড়ে উর্বর কৃষিভূমি। সারা মহকুমার অর্থনীতি পুষ্ট হয়েছিল তাতে। এগুলি ছাড়াও, নীল চাষ, লোহা-কাঁসা-পিতলের ধাতু শিল্প, পটশিল্প, শঙ্খশিল্প ছিল এই এলাকায়। সোনায় সোহাগা হয়েছিল বয়নশিল্প। পাট, বিশেষ করে রেশম উৎপাদন আর বয়ন, সমৃদ্ধির একেবারে শিখরে নিয়ে গিয়েছিল মহকুমার অর্থনীতিকে।
এই মহকুমার চন্দ্রকোণা, রাধানগর, দাসপুরের মতো, ক্ষীরপাইও সেসময় রেশম শিল্পের সুবাদে ভারতের বাইরেও পরিচিত হয়ে উঠেছিল। সরাসরি এই এলাকায় এসে, রেশমশিল্পে অংশ নিয়েছিল ওলন্দাজ, ফরাসী, আর্মেনীয়, ইংরেজ প্রভৃতি বিদেশি বণিকের দল। এইসকল ইউরোপিয়ান বণিকদের নীলকুঠি, রেশমকুঠি, বসবাসের অট্টালিকা ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল এখানে। কিছু নিদর্শন এখনও দেখা যায়।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে, অন্যান্য নানা পেশাগোষ্ঠীর মানুষজনও উপস্থিত হয়েছিল ক্ষীরপাইতে। এসেছিল মালাকার, কুম্ভকার, কর্মকার, স্বর্ণবণিক, গন্ধবনিকেরা। বিত্তবান হয়ে উঠে, মন্দির প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন এঁদের কেউ কেউ।  সেই বিকাশের সময় হালদার এবং দত্ত—এই পদবীর দুটি গন্ধবণিক পরিবার বিশেষ সম্পদ শালী হয়ে উঠেছিল। মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল দুটি পরিবারই।

মুঘল আমলের একটি বিখ্যাত পথ হল—বাদশাহী সড়ক। গৌড় থেকে, গড় মান্দারণ পার হয়ে, ক্ষীরপাইয়ের উপর দিয়ে দক্ষিণে প্রসারিত হয়েছে এই পথ। বাণিজ্যের ভারী সহায়ক ছিল পথটি। ক্ষীরপাই নগরীতে, এই পথের সামান্য পূর্বে, কদম কুণ্ডু। সেখানে একটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল দত্ত পরিবার। সেই মন্দির নিয়েই এই আলচনা।
রেশম শিল্পের পতনের কাল থেকেই মন্দিরেও সঙ্কটের সূচনা দেখা গিয়েছিল। দত্ত পরিবার অপারগ হয়ে পড়লে, স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মানুষজন এগিয়ে এসেছিলেন। দাঁড়িয়ে ছিলেন মন্দিরের পাশে। আজও তাঁরা আছেন। একটি কমিটি গড়ে, দেবতার সেবা পূজা আর মন্দিরের দেখভাল সব দায়িত্বই পালন করে এই কমিটি।
মন্দিরে একটি প্রতিষ্ঠা- লিপি আছে—“শ্রীশ্রীখড়কে / সর শিব ঠাকুর / সকাব্দ ১৭৮৩/৫/২১ / সন ১২৬৮ সাল শ্রী গঙ্গাধর দত্ত”। এই বয়ান অনুসারে জানা যাচ্ছে, শকাব্দ ১৭৮৩, বা বঙ্গাব্দ ১২৬৮ সন, অর্থাৎ ইং ১৮৬১ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক গঙ্গাধর দত্ত।
উঁচু ভিত্তিবেদির উপর, দক্ষিণমুখী আটচালা রীতির মন্দির। উচ্চতায় প্রায় ৪৫ ফুট। সামনে ইমারতি থাম আর খিলানের তিনটি দ্বারযুক্ত অলিন্দ। (পরে, সংস্কার কাজের সময় আকার বদল হয়েছে) পিছনে এক-দ্বারি গর্ভগৃহ। পশ্চিমের দেওয়ালে তিনটি ‘প্রতিকৃতি দ্বার-পথ’ রচিত হয়েছে।

দুটি বৈশিষ্ট আছে মন্দিরে—১. গর্ভগৃহের পূর্ব দেওয়ালে বড় আকারের গোলাকার ‘সূর্য ভেদ’ রচিত আছে। ২. মন্দিরের মাথায় একটির বদলে, তিনটি শীর্ষক বা চুড়া নির্মিত হয়েছে। প্রতিটিতে বেঙ্কি, আমলক, ৩টি করে কলস এবং ত্রিশূল-দণ্ড স্থাপিত। এই জেলার তমলুক শহরের জগন্নাথ মন্দিরেও এই নিদর্শন দেখা যায়।
মন্দিরে অলঙ্করণের কাজ সামান্য– ছোট ছোট খোপে ৩ সারি টেরাকোটা ফলক, পঙ্খের কিছু ফুলকারি নকশা, আর দুটি দ্বারপালক মূর্তি।
তবে, মন্দিরটি বেশ সযত্ন রক্ষিত এবং দৃষ্টিনন্দন।
সাক্ষাৎকার : সর্ব শ্রী শ্যামল দে, অরুণ সরকার, সুশান্ত পাত্র, অসীম মণ্ডল, অশনি কারক—কদমকুণ্ডু, চন্দ্রকোণা শহর।
যাত্রাপথ : চন্দ্রকোণা হয়ে মেদিনীপুর-ঘাটাল পথের উপরেই ক্ষীরপাই শহরে মন্দিরটি অবস্থিত।

- Advertisement -
Latest news
Related news