নরেশ জানা ও শশাঙ্ক প্রধান: প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা (Pradhanmantri Awas Yojnana) কিংবা বাংলা আবাস যোজনা (Bangla Awas Yojana) যে নামেই ডাকা হোক মোটের ওপর সেটি একটি এক কামরার বাড়ি যার মাথার ওপর থাকতে হবে একটা ঢালাই করা ছাদ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেলেঘাই নদী ঘেঁষা সবং থানার কুলভেড়ি, নেজিভেড়ি, মাসুমপুর, মুরারিচক, মার্কন্ডচক ইত্যাদি গ্রাম। সেই সব গ্রামেরই একটি গ্রামের দু’কামরার মাটির বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই গৃহকর্তা অনন্ত বর্মন (নাম পরিবর্তিত) হাত কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এলেন। পরনে গামছা ও হাতাওয়ালা স্যান্ডোগেঞ্জি। গলায় তুলসি কাঠের কন্ঠি। বৈষ্ণব এবং বিনয়ী মানুষটি মাদুর পেতে দেন বাড়ির দাওয়ায়। বাড়ির সামনে দাঁড় করানো একটা হাফস্ট্যান্ড করা বাইক, হিরো কোম্পানির। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার আবাস যোজনার বাড়িটি কোথায়? মানুষটি আগের মতই হাত কচলে বলেন, ‘করা হয়নি আজ্ঞে। এবার চাষ উঠলেই নামিয়ে দুব।’
কিন্তু টাকা পেয়েছেন তো ২০১৭ সালে এখন ২০২২ সাল। ইট বালি চিপস সিমেন্টের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ থেকে চারগুন। বাড়ি করবেন কী করে? অনন্ত বর্মন জানালেন, আর না করে উপায় নেই। চেয়েচিন্তে মহাজনের কাছে ঋণ করে হলেও বাড়ি করতেই হবে না’হলে কোমরে দড়ি পড়বে। এফ.এই.আর হয়েছে তাঁর নামে। অনন্ত আরও জানালেন, ছেলেটার জন্যই এই ভোগান্তি। তখন বাড়ির টাকা দিয়ে বাইক কিনে বসে রয়েছে। বলেছিল পরে কাজ টাকা দেবে কিন্তু কোথায় কাজ। মাঝখানে লকডাউন আরও বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। অনন্ত যেমন বাড়ির টাকায় ছেলের গাড়ি কিনেছেন নেজিভেড়ির আরেকজন আবার ওই টাকায় বউয়ের জন্য ৮ আনার সোনার চেন গড়িয়েছেন। জানালেন, ‘তখন সোনার দাম কম ছিল তাই হয়ে গেল বুঝলেননা।’ এখন তাঁর নামেও এফএআইআর হতেই বউয়ের হার বেচার কথা ভাবছিলেন। বললেন, ‘এখন সোনার দাম বেশ চড়া। ভালো টাকাও পাওয়া যাবে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বউ কিছুতেই হার গলাছাড়া করতে রাজি নয়।’
এই ভাবে শুধু সবং এলাকাতেই অন্ততঃ শ’ দুয়েক মানুষ পাওয়া যাবে যাঁরা আবাস যোজনার টাকা নিয়েছেন কিন্তু বাড়িই করেননি। কেউ প্রথম কিস্তির টাকা পেয়েছিলেন কেউ আবার ম্যানেজ করে দ্বিতীয় কিস্তিও তুলে নিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রথম কিস্তির টাকায় অন্ততঃ লিনটন অবধি না গাঁথলে দ্বিতীয় কিস্তির টাকা মেলেনা। কিন্তু অনেকে অন্যের গাঁথা বাড়ি বলে দেখিয়ে দ্বিতীয় কিস্তিও ম্যানেজ করে নিয়েছেন। এখনও অবধি সবং এলাকায় ৩২ জনের নামে সরকারি টাকা তছরুপের অভিযোগে এফআইআর হয়েছে। যেখানে বিষ্ণুপুর গ্রাম পঞ্চায়েত ছাড়াও রয়েছে নওগাঁ, বুড়াল গ্রাম পঞ্চায়েত। বিষ্ণুপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান শিউলি করন জানিয়েছেন, “আমরা প্রথম দিক থেকে ধরেছি। ২০১৬-১৭ সাল। এঁদেরকে আগে নোটিশ করা হয়, বাড়িতে বানাতে বলা হয়। যাঁরা ওই নোটিশ পেয়েও বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করেনি সেরকম ১৪জনের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। এরপর অন্য আর্থিক বছরগুলিও ধরা হবে। হয় টাকা ফেরৎ দেবেন নয় বাড়ি বানাবেন।” প্রধান জানান, এরা সবাই প্রথম কিস্তির টাকাই পেয়েছিল।
বিষ্ণুপুরে যেমন ১৪জনের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে তেমনই নওগাঁ ও বুড়ালে ৯জন করে মোট ১৮জনের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে। আবাস যোজনার টাকায় কেউ যেমন ছেলের গাড়ি কিংবা বউয়ের গহনা কিনেছেন তেমন কেউ আবার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, কেউ কিনেছেন দু-চার কাটা জমি। কেউ স্রেফ খেয়েই উড়িয়ে দিয়েছে। শুধু সবং নয় এমন ঘটনার স্বাক্ষী পুরো পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাই। এক সরকারি আধিকারিক জানিয়েছেন, টাকা পেয়ে বাড়ি বানাননি এমন মানুষের সংখ্যা সারা জেলায় আড়াই হাজার ছাড়িয়ে যাবে। ওই সরকারি আধিকারিক আরও জানিয়েছেন, একটা বড় অংশের মানুষ দ্বিতীয় কিস্তিরও টাকা তুলে নিয়েছেন। এটা পুরোপুরি জালিয়াতি যার সাথে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য ও জব আ্যসিসটেন্টও জড়িত থাকতে পারেন কারন প্রথম কিস্তির টাকায় ঘর শুরু না করলে দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া যায়না। আর প্রথম কিস্তির টাকায় কাজ হয়েছে কিনা এটা দেখার দায়িত্ব স্থানীয় পঞ্চায়েত ও জব আ্যসিসটেন্টরও। সুতরাং মামলা চালু হলে তাঁরাও অভিযুক্ত হয়ে যাবেন বিশেষ করে যেখানে দ্বিতীয় কিস্তির টাকা অনুমোদন হয়ে গেছে অথচ বাড়ি শুরুই করা হয়নি।’