নিজস্ব সংবাদদাতা: খুব এদিক ওদিক না হলে খড়গপুর পুরসভার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের জয়ী বিজেপি প্রার্থী হিরন্ময় চট্টোপাধ্যায় তথা অভিনেতা হিরণকে সামনে রেখেই খড়গপুর পুরসভার বোর্ড গঠন করতে চলেছে তৃনমূল কংগ্রেস। অন্ততঃ এমন জল্পনাই এখন ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে রেল শহরে। খড়গপুর শহর বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায়ের পৌরভোটে দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়েই যে সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল এখন তা নাকি এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। হিরণ যে তৃণমূলে যেতে চলেছেন এমন আশঙ্কা বিজেপি আগে থেকেই করেছিল যে কারনে পুর নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই তাঁর সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেছিল সাংসদ দিলীপ ঘোষ গোষ্ঠী। যে কারনে পুরসভার প্রার্থী তালিকা তৈরি করার সময় নির্মমভাবেই ছেঁটে ফেলা হয়েছিল হিরনের প্রস্তাবিত তালিকা। বিজেপির ভয় ছিল, ভোটের জেতার পর নিজস্ব প্রার্থীদের নিয়েই তৃণমূলে যোগ দেবেন তিনি। যদিও খড়গপুর পুরসভায় ২০টি আসন জিতে নেওয়ায় আর কারও সমর্থনই লাগবেনা তৃনমূলের। যদিও হিরণকে গিলতে হবেই শহর তৃনমূলের কারন রাজ্য তৃণমূল হিরণকে সামনে রেখেই খড়গপুরের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে।
হিরণের বাড়তি লাভ খড়গপুরে ২০০০ সাল থেকে টানা জিতে আসা তৃণমূল প্রার্থী খড়গপুর পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান জহর লাল পালকে হারানো। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে হিরণ জহরলাল পালকে ১০৮ ভোটে হারিয়েছেন তিনি। ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে দলের এই হারে কার্যত খুশিই তৃনমূল কারণ দলের বক্তব্য, দলের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি তাঁর পুত্রবধূকে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে দাঁড় করিয়েছিলেন এবং বারংবার সতর্ক ও হুঁশিয়ারীর পরও সেই প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করান নি। ভোটের মাত্র কয়েকদিন আগেই তাই শহর যুব সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় জহরলাল পালের ছেলে অসিত পালকে। ঘটনাক্রমে ৩৩ এবং ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে জহরলাল পাল ও তাঁর পুত্রবধূ নির্দল প্রার্থী জয়া পালের পরাজয়ের ফলে দল আরও কঠোর ভূমিকা নেবে বলা বাহুল্য কিন্তু তার আগে জহরপালকে হারানোর পুরস্কারও দেওয়া হবে হিরণকে।
হিরণ ছাড়া তৃনমূলের পুরবোর্ডের চেয়ারম্যান হতে পারতেন প্রদীপ সরকার। এবার ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জিতে আসা প্রদীপ বিদায়ী পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ছিলেন আড়াই বছরের বিধায়ক এবং পুর প্রশাসক। ২০১৫ সালে দলীয় কোন্দল ঠেকাতে রাজনীতিতে নবাগত প্রদীপ সরকারকেই চেয়ারম্যান পদে বসানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ। পরে তাঁকে খড়গপুর শহর বিধানসভা ক্ষেত্রের উপনির্বাচনেও প্রার্থী করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। জিতেও আসেন প্রদীপ। কিন্তু এতে করে খড়গপুর শহরে যেমন দলীয় কোন্দলের অবসান ঘটেনি তেমনই প্রদীপের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ কালীঘাটকে বিব্রত করেছে। খড়গপুর শহরের এক তৃনমূল নেতার কথায়, বেশ কিছু দুর্নীতির অভিযোগ, রাতারাতি বহু বিষয় সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠা, খড়গপুর শহরে প্রাসাদোপম সুরম্য অট্টালিকা বানানো দলের নজরে এসেছে। সর্বোপরি ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য জুড়ে সবুজ ঝড়েও প্রদীপ সরকারের পরাজয় দলকে ভাবতে বাধ্য করিয়েছে। দল বুঝেছে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ, শহরের নিকাশি সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা, কালো অব্যবহার যোগ্য পানীয় জল সরবরাহ ডুবিয়েছে দলকে। তাই চেয়ারম্যানের আসনের লড়াই থেকে হয়ত অনেক দুরে সরে যেতে বসেছেন প্রদীপ।
অন্যদিকে প্রার্থী হতে না পেরে তৃনমূল থেকে বেরিয়ে খড়গপুর সদরে বিজেপির বিধায়ক হিসাবে জয় হিরণকে তাঁর পুরানো দলের কাছে আরও দামি করেছে। তাঁকে সম্মানে ফেরানোর চোরা প্রক্রিয়া চলছিল বহুদিন ধরেই কিন্তু তাঁকে কী পদ দেওয়া যায় তাই নিয়ে পরিকল্পনা হচ্ছিল এতদিন। তিনি বিজেপির বিধায়ক তাই তাঁকে দলে ফিরিয়ে মন্ত্রিত্ব দেওয়া যাবেনা। তাই তাঁর পুনর্বাসনের জন্য অপেক্ষা করছিল তৃনমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বিশেষ করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়ত সেই পুনর্বাসনের সময় এবার সামনে এল। দলের সঙ্কেত পেলেই বিজেপি ছেড়ে তৃনমূলে যোগ দেবেন তিনি এমনটাই খবর। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ খড়গপুর শহর তৃনমূলের তরফ থেকে কোনও নেতাকেই চেয়ারম্যান পদে আপাততঃ ভাবছেনা তৃনমূলের রাজ্য নেতৃত্ব।
গোটা নির্বাচনী প্রচারে কোথাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃনমূল কংগ্রেসকে কোনও ভাবেই আক্রমণ করেননি হিরণ। বরাবরই তাঁর আক্রমনের লক্ষ্যে ছিল প্রদীপ সরকার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী জহরলাল পাল। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকারকে প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, ” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য সরকার খড়গপুরের উন্নয়নের জন্য যে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন তা নিজের বাড়ির তলায় ঢুকিয়েছেন প্রদীপ সরকার। আমার কাজ হবে মাটির তলা থেকে ওই টাকা খুঁড়ে বের করা।” পাশাপাশি তিনি এও বলেছেন, খড়গপুর শহরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকজন সুসন্তান রয়েছেন কিন্তু প্রদীপ সরকার হচ্ছেন তাঁর কুলাঙ্গার সন্তান।” স্পষ্টতই হিরণের এই উক্তি শুধুমাত্র তৃনমূলের যোগদানের ইঙ্গিত ছিল নাকি তারও বাইরে গিয়ে প্রদীপ সরকারের বিরুদ্ধে আইনি অভিযানের হুমকি সেটাও এখন দেখার।
অবশ্য খড়গপুর শহরে হিরণের চলে যাওয়াটাই বিজেপির একমাত্র ঝটকা হয়ে দাঁড়াবে এমনটা নয়। তার চেয়েও বড় ধাক্কা বিজেপির নির্বাচনের ফলাফলে। বিধানসভায় জিতে আসা বিজেপি কার্যত: মুখ থুবড়ে পড়েছে পৌরসভায়। হিরণ সহ মাত্র ৬টি আসন তারা পেয়েছে ৩৫টি আসনের মধ্যে। অন্যদিকে কংগ্রেসের ৬টি আসন সহ বামজোট ৮টি আসনে জয়ী হয়েছে। ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে তৃনমূল কংগ্রেস এবং নির্দল জয়ী হচ্ছে ১টি আসনে।