জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
রাধাকৃষ্ণ মন্দির, মীরগোদা (পূর্ব মেদিনীপুর)
বর্তমানে বাংলায় হিন্দুধর্ম, বিশেষত বৈষ্ণব ধর্ম চর্চায় ‘ইস্কন’ (ISCON—International Society for Krishna Conciousness) একটি বেশ অগ্রণী নাম। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন টালিগঞ্জের এক বনেদি পরিবারের সন্তান। সেকালের নৈতিক শিক্ষার পীঠস্থান, কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের কৃতিছাত্র ছিলেন অভয় চরণ দে। ‘গৌড়ীয় মঠ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতীর কাছে দীক্ষিত হয়ে, ‘অভয় চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। গুরুর আদেশে পাশ্চাত্য এলাকায় (ইউরোপ-আমেরিকা) শ্রীচৈতন্যদেবের বাণী প্রচারেরর দায়িত্ব পেয়ে, ইস্কন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বামী প্রভুপাদ।
ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতীর আর এক কৃতি শিষ্য এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটির কথা এই জার্ণালে বলব আমরা। মেদিনীপুর জেলার একেবারে দক্ষিণতম প্রান্ত মীরগোদা পরগণা। সেখানে ২০০০ হাজার বিঘা সম্পত্তির এক সম্পন্ন বনেদি পরিবারের সন্তান কৃষ্ণপ্রসাদ দাস। তিনিও ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতীর কাছে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তিনি নিয়েছিলেন বাংলা-ওডিশা সীমান্ত এলাকায় প্রচারের দায়িত্ব।
দীক্ষালাভের পর, গুরুদেবের নাম যুক্ত করে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন– ‘ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী কুঞ্জ’। পৈত্রিক সম্পত্তির পুরো অর্ধেক, মানে ১০০০ বিঘা সম্পত্তি উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন দেবতার নামে।
বসতবাড়ির পাশেই প্রাচীরে ঘেরা মঠবাড়ি গড়ে, তার ভিতরেই গড়েছিলেন রাধা-কৃষ্ণ নামিত একটি মন্দির। এছাড়া, পুরীর স্বর্গদ্বার এলাকায় বড় মাপের একটি যাত্রীনিবাস, ভূবনেশ্বর শহরে একটি রাধাকৃষ্ণ মন্দিরও গড়েছিলেন কৃষ্ণপ্রসাদ।
১০০০ বিঘা সম্পত্তি কম কথা নয়। মহা আড়ম্বরে সেবাপূজা আর বারো মাসে তেরো পার্বণের আয়োজন হত। সদাব্রত ছিল, সাধু-সন্ন্যাসীর দল এসে বিশ্রাম নিতেন তীর্থ পরিক্রমার যাত্রাবিরতি ঘটিয়ে। ভক্তজন, অভাবী মানুষেরাও দেবতার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হতেন না। কিন্তু স্বাধীন্তার পর, কালে কালে সেসব কিছুই কমে গিয়েছে একটু একটু করে। সেবাপূজার সবই আছে এখনও, তবে পূর্বের আড়ম্বরটিকে আর ধরে রাখা যায়নি। মন্দিরটি সাফসুতরো রাখা গেলেও, জীর্ণতার চিহ্ন সারা মঠ জুড়ে।
উঁচু প্রাচীরে ঘেরা প্রাঙ্গন। প্রাচীরের মূল ফটকটি বড় মাপের। শিখরে দুটি ব্যাদিত-বদন লম্ফোদ্যত সিংহ। দু’পাশে থাম আর দ্বারপাল মূর্তি। দ্বারপথের মাথায় তিন স্তরের নকশাকাটা খিলান। জ্যামিতিক কারুকাজ আর পঙ্খের বিভায় একদিন যে অপরূপ সাজে সেজেছিল ফটকটি, আজ তার ভারি ম্লান অবস্থা। ফটক পার হয়ে, ভিতরে প্রথমেই একটি বড়মাপের বারোদুয়ারি নাটমন্দির। মাথায় কড়িবরগার ছাউনি দেওয়া। ডানহাতে আর একপ্রস্থ প্রাচীরে ঘেরা অঙ্গনে একটি দ্বিতল অট্টালিকা। ওপরে মহারাজ, অতিথি আর সেবকদের আবাস ছিল অতীতে। নীচে ভাঁড়ার ঘর, ভোগশাল, পাকশাল ইত্যাদি। এই ভবনটিরও ভারি জীর্ণ দশা এখন।
রাধাকৃষ্ণের মন্দিরটি নাটমন্দিরের পশ্চিমে। উঁচু বেদীর উপর ইটের তৈরি পূর্বমুখী মন্দিরটি পঞ্চরত্ন রীতির। উচ্চতা প্রায় ফুট তিরিশেক। একটি প্রদক্ষিণ-পথ মন্দিরকে ঘিরে আছে।
অলিন্দ নাই, সেকারণে গর্ভগৃহটি বড় মাপের। মাথায় চালা ছাউনি। উপরের পাঁচটি রত্নে কোনও দ্বারপথ নির্মিত হয়নি। তবে, চারদিকের দেওয়ালেই কলিঙ্গ প্রভাবে রথ বিন্যাস করা। কেন্দ্রীয় রত্নে পঞ্চ-রথ আর কোণেরগুলিতে ত্রি-রথ বিন্যাস।
বা-রিলিফ রীতির দু’য়েকটি মূর্তি ছাড়া তেমন কোন অলঙ্করণ মন্দিরটিতে নাই।
সাক্ষাৎকার “ সর্বশ্রী বিজন কুমার দাস (অপু), বিনয় কুমার দাস (সপু)—মীরগোদা। পূর্ণচন্দ্র পণ্ডা (গালু), পুরোহিত।
সমীক্ষা-সঙ্গী: শ্রী জ্যোতির্ময় খাটুয়া, (ট্রাভেল এক্সপি মিডিয়া, কলকাতা), বালিসাই।
পথ-নির্দেশঃ দীঘাগামী পথে, দীঘা পৌঁছুবার আগেই টিকরা মোড়। সেখান থেকে কিমি ১৩ উজিয়ে মীরগোদা।