নিজস্ব সংবাদদাতা: বিকাল ৫টা, খুব বেশি হলে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতেন তাপস দাস। খড়গপুর শহরের খরিদার বিলাসমোড়ের বাড়িতে ফিরেই ৪ বছরের সুইটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করা চাই। সুইটি ছোট মেয়ে, ছোট বলেই বাবার কাছে ওর আবদারটা বেশি কিন্তু তাই বলে বড় মেয়ে ১১ বছরের মিমির জন্য কম ভালোবাসা ছিলনা। ছোট বোনকে বাবা যখন আদর করত মিমি তখন বাবার শরীর লেপ্টে থাকত। মিমি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের ক্লাস সিক্সের ছাত্রী। সে একটু একটু বুঝতে পারছে বাবার কিছু একটা হয়েছে। নাহ’লে বাবা এত দেরি করছে কেন? বাবা খুব দেরি করলে মাকে ফোন করে জানাতো। দু’একবার মাকে জিজ্ঞাসাও করেছে বাবার কোনও ফোন এসেছে কিনা? উত্তর পায়নি মায়ের কাছ থেকে। মা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে, ঠাকুমা কাঁদছে। দুই বোন তাই চুপচাপ ঘরের সামনে বসে আছে, কেন এত লোকজনের ভিড় বুঝতেই পারছেনা।
ওদিকে ১২ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, এখনও খোঁজ মেলেনি খড়গপুরের রেলকর্মী তাপস দাসের। রাত প্রায় ১০টা, কাঁসাই নদীতে ফ্ল্যাড লাইট জ্বেলে র্যাফটার নামিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছেন NDRF কর্মীরা। সকাল ৯.৫৫ নাগাদ কাঁসাই রেলসেতুর ঠিক যে অংশটায় ওপর থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিলেন রেলের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ট্র্যাকম্যান ৪৫ বছরের তাপস দাস সেই অংশ থেকে এপাশে ওপাশের দেড় কিলোমিটারের বেশি অংশ জুড়ে নিবিড় তল্লাশি চালিয়েছেন NDRF কর্মীরা। তল্লাশি অভিযান চলছে ৮ ঘন্টারও বেশি কিন্তু দেহ মেলেনি তাপসের। কাঁসাই নদীতে তল্লাশি অভিযান যখন চলছে তখন পাড়ার কিছু ছেলেও বসে রয়েছেন ‘তাপস-দা’ র খোঁজ মেলার আশায়। সেরকমই এক যুবক দীপক দাস জানালেন, ” আমরা বুঝতে পারছিনা পাড়ায় ফিরে গিয়ে কী জবাব দেব তাপসদার পরিবারের কাছে। পুরো পরিবারটাই মনে হচ্ছে ভেসে গেল। খুব কষ্ট হচ্ছে তাপস-দার মায়ের জন্য। তাপস-দা যখন খুব ছোট তখন তাপসদার বাবা মারা যান। তাপসদার মা-ই তাপস-দা আর তাঁর দাদা দীপঙ্করদাকে বড় করেছেন। সেই মা বেঁচে থাকতেই এরকমটা হয়ে গেল?”
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিধবা মাকে নিয়েই তাপস দাস ও তাঁর দাদা দীপঙ্কর দাস থাকতেন। যৌথ পরিবার। তাপস দাসের স্ত্রী মমতা ও দুই মেয়ে। অন্যদিকে দীপঙ্কর দাসের স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান। ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই মা, ভাতৃবধূ ও ভাইজিদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এখনও ভাইয়ের কোনও খোঁজ না মেলায় বাড়িতে কিছু বলতেও পারছেননা। ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের খরিদা বিলাসমোড়ের দাস পরিবারে গিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন শহর তৃনমূল কংগ্রেসের সভাপতি দীপেন্দু পাল, ১৯নম্বর ওয়ার্ডের যুব সভাপতি বরুণ ঘোষরা। বরুণ জানিয়েছেন, ‘ আমাদের ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজু গুপ্তা বাইরে আছেন। তিনিও খোঁজ খবর নিচ্ছেন। আমরা সত্যি খুব বিস্মিত যে ১২ ঘন্টা পেরিয়ে গেল অথচ এখন খোঁজ মিললনা মানুষটার! রেলের আধিকারিকদের কাছে আমাদের একটাই আবেদন আরও নিবিড় তল্লাশির জন্য বেশি বেশি করে লোক নিয়োগ করা হোক। একটা পরিবার কতক্ষণ এই দুশ্চিন্তা নিয়ে থাকতে পারে?”
এখনও অবধি দেহ না মেলায় বিস্মিত NDRF কর্মীরাও। মানুষটা কী রাতারাতি উধাও হয়ে গেল? সাধারণভাবে যেখানে জলে কেউ ডুবে গেলে ৪/৫ ঘন্টার মধ্যে দেহ ভেসে ওঠার কথা সেখানে ১২ ঘন্টা পরেও কেন খোঁজ মিলছেনা তাপসের। একটা আশঙ্কা আছে যে সেতুর নিচে বড় বড় থামগুলির গভীর গর্তে পড়ে কী বালির স্তর চাপা দিয়ে ফেলল নাকি জামা কাপড়ের কোনও অংশ কিছুতে আটকে গিয়ে দেহ ভেসে উঠতে বাধা পাচ্ছে। আরেকটা আশঙ্কা হল নদী স্রোতের পূর্ব অংশে ঘন কচুরিপানা। সেই কচুরিপানার স্তর এতটাই পুরু যে তার তলায় দেহ থাকলে খুঁজে পেতে দেরি হবে। বিশেষ করে রাত্রি নেমে যাওয়ায় তল্লাশি চালানো যখন মুশকিল হয়ে পড়েছে। এদিকে রাত দশটায় আজকের মত উদ্ধার কাজ শেষ করে দিয়েছে NDRF কর্মীরা।