নিজস্ব সংবাদদাতা: ২দিন ধরে লড়ে গেল ছেলেটা, লড়ে গেল নিজের মত করেই, তারপর ক্রমশঃ অবসন্ন হতে হতে এক সময় মৃত্যুর হাতে ছেড়ে দিল নিজেকে! হাতুড়ে কিংবা এমবিবিএস কোনও চিকিৎসকই ধরতেই পারলনা ছেলেটাকে সাপে কামড়েছে? শুক্রবারই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। ফলের নিরীখে এবার জেলা কেন রাজ্যের সেরা স্কুল পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার জলচক নটেশ্বরী নেতাজি বিদ্যায়তন। মেধা তালিকায় দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ সহ ২২জন উঠে এসেছে প্রথম দশে। হয়ত আর দু’বছরের মাথায় ২০২৫ সালের উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা ২০২৩ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার মেধা তালিকায় নাম থাকত রক্তিম ভৌমিকের! রক্তিম ভৌমিক জলচক নটেশ্বরী নেতাজি বিদ্যায়তনের দশম শ্রেণীর প্রথম হওয়া ছাত্র বা ফার্স্ট বয়। বৃহস্পতিবার মধ্যবিত্ত পরিবারের ১৫ বছর বয়সী উজ্জ্বল প্রতিভা রক্তিম নিভে গেল অকালেই।
জলচক নটেশ্বরী নেতাজি বিদ্যায়তনের প্রধান শিক্ষক তরুণ কুমার চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ” বড়ই মর্মান্তিক এই সংবাদ, ভালো ফল করার আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে আমাদের ক্লাস টেনের ফার্স্ট বয়ের মৃত্যুর ঘটনায়। আমরা আমাদের এই ঐতিহাসিক ফল রক্তিম ভৌমিককে উৎসর্গ করছি।
রক্তিমের বাড়ি পিংলা থানার কেলেয়াড়া গ্রামে। বাবা রমেন ভৌমিক কৃষিকাজ করেন, মা গৃহবধূ। মাটির দেওয়াল আর আ্যসবেস্টারের চাল। পরিবার ও বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে রক্তিম শুধু যে পড়াশুনায় অসম্ভব মেধাবী ছিল তাই নয় ছিল খুবই নিষ্ঠাবান ও পরিশ্রমী ছাত্র। রক্তিমের বড়দা বয়সে রক্তিমের থেকে অনেকটাই বড়। টিউশনি পড়ান। বাবা কৃষক, সামান্য জমি জিরেত রয়েছে। বাবা এবং দাদার উপার্জনে চলে সংসার।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/06/Screenshot_20220610-180306_PicsArt.jpg)
তারই মধ্যে রক্তিম প্রতিবারই ক্লাসে ভালো ফলাফল করে আসত। দুর্ঘটনাটি ঘটে মঙ্গলবার রাত্রি বেলায় যা বুঝতেই পারেনি রক্তিম কিংবা তাঁর পরিবার অথবা চিকিৎসকরাও। বুধবার সকালে সামান্য অসুস্থতা নিয়ে টিউশন পড়তে যায় রক্তিম। ফিরে এসে মাকে জানায় মাথার যন্ত্রনা হচ্ছে আর শরীরটা কেমন করছে। দেখানো হয় স্থানীয় গ্রামীন চিকিৎসককে। তিনি গ্যাসের সমস্যা অনুমান করে ওষুধ দেন। কিন্তু তাতে যন্ত্রণার উপশম হয়নি বরং তা আরও বাড়তে থাকে।
ওই দিনই ফের দেখানো হয় একজন এমবিবিএস চিকিৎসককে। তিনিও অনুমান করেন গ্যাসের সমস্যা। রক্তিম নিস্তেজ হয়ে পড়ছে দেখে তিনি ওষুধের সাথে চালু করেন স্যালাইন। কিন্তু ওই দিন রাতে অবস্থার আরও অবনতি হয়, শুরু হয় কোমরের (আসলে কিডনি) ব্যথা। বন্ধ হয়ে যায় পেচ্ছাপ। বৃহস্পতিবার রক্তিমকে নিয়ে পরিবার ছোটেন পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সদর তমলুকে। রক্তিম ততক্ষণে নির্জীব হয়ে পড়েছে।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/06/Screenshot_20220610-180408_PicsArt.jpg)
নার্সিং হোমে নিয়ে গেলে ওর অবস্থা দেখে নার্সিংহোম নিতে রাজি হয়নি। অগত্যা তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তমলুক জেলা হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে মৃত্যু হয়েছে তার। তমলুক বাড়ি নিয়ে শুরু হয় রক্তিমকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি। শোকার্ত পরিবার যখন রক্তিমকে চিতায় তোলার আগে শেষবারের মত স্নান করানোর জন্য শরীরে তেল মাখাচ্ছিল তখনই নজরে পড়ে
পায়ের তলায় দুটি দাঁতের দাগ। একটি আলতো, একটি গভীর।
এরপরই চিকিৎসকদের অনুমান রক্তিমকে ঘুমের ঘোরেই ক্ষীণবিষ চিতি সাপ কামড়ে ছিল। যে কারনে অত্যন্ত ধীরে ধীরে তার শরীরে বিষ সঞ্চার হয়। সর্পবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন চিতি সাপের কামড় অনেক সময় এতটাই মৃদু যন্ত্রনাদায়ক হয় যে বিষাক্ত পিঁপড়ে বা পোকার চেয়েও কম যন্ত্রনা অনুভব হয়। ভালো করে ক্ষতস্থান পরীক্ষা না করলে অনেক সময় বোঝাই যায়না। মাথা যন্ত্রনা, শরীরের অস্বস্তি, পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যাওয়া সবই সাপের বিষক্রিয়ার জন্য হলেও তাকে যে কোনও কিছু কামড়েছে এটাই সে নিজে কিংবা অন্যরাও বুঝতে পারেনি। ফলে চিকিৎসকরা ওই উপসর্গ দেখে গ্যাসের চিকিৎসা করে গেছেন। রক্তিমের মৃত্যুর খবরে পরিবারের পাশাপাশি সহপাঠী, শিক্ষক, প্রতিবেশীদের মধ্যেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া।