Saturday, July 27, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ১৪২ ।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
শিব মন্দির, কর্ণেলগোলা (মেদিনীপুর শহর)

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

জীর্ণতার চিহ্নটুকুও নাই এই মন্দিরে। পলেস্তারা থেকে খসে পড়েনি বালির একটি দানাও। তবুও, এই জার্ণালে মন্দিরটির স্থান হয়েছে দুটি কারণে—১. জীর্ণতার হাত থেকে বেঁচে উঠেছে দেবালয়টি। এবং ২. তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হোল, মন্দির সৌধটির গড়ন। একটু বিরল রীতিতে গড়া হয়েছে এটিকে। একারণেই আজকের কথকতা এই মন্দির নিয়ে।

মেদিনীপুর শহরে ‘সাহা’ পদবীর বেশ কিছু মানুষ আছেন। আদিতে তাঁরা পশ্চিম ভারত থেকে আসা বৈশ্য সম্প্রদায়। পদবী ছিল—সাহু। জীবিকা ছিল মহাজনী ব্যবসা। বাংলায় এসে কালে কালে ‘সাহা’ পদবী হয়েছে তাঁদের। এমনই একটি বৈশ্য পরিবার নিজেদের বসতবাটির সাথে একটি শিবালয় গড়েছিলেন।

পরবর্তীকালে শহরের মুরারকা পদবীর একটি ব্যবসায়ী পরিবার সাহাদের কাছ থেকে সম্পত্তিটি কিনে নিয়েছিলেন। মুরারকারা এসেছিলেন রাজস্থান থেকে। ব্যবসাদির মাধ্যমে ধনবান হয়েছিল পরিবারটি। খরিদা সম্পত্তির ভিতরেই ছিল একটি জীর্ণ শিবালয়। সেটিকে সংস্কার করে, নিয়মিত পূজার্চনা করে চলেছেন তাঁরা।
এখানে জানানো দরকার, পূজার্চনার মাধ্যমে দিনযাপনের অভ্যাস মুরারকা পরিবারের স্নায়ুতে স্নায়ুতে প্রবাহিত। দিনের পূজায় ব্রাহ্মণ এসে পৌরহিত্য করেন। কিন্তু সন্ধ্যায় মহাদেবের পূজা বা আরতি করেন মুরারকা পরিবারের সদস্যরাই।
যাইহোক, এবার মন্দিরটির দিকে একবার দৃষ্টি দেওয়া যাক। পশ্চিমমুখী ইটের মন্দিরটি চালা-রীতির আট-চালা মন্দির হিসাবে নির্মিত হয়েছে। আদিতে এর ভিত্তিবেদীটি বেশ উঁচুই ছিল। একবার সংস্কার কাজের সময় সমস্ত অঙ্গণটি ভরাট করার কারণে, বেদির নীচের অর্ধেক অংশ মাটির নীচে চাপা পড়ে গিয়েছে। বেদীর প্রতিটি দেওয়াল তিনটি করে চতুষ্কোণ খোপে ভাগ করা ছিল। বর্তমানে তার উপরের অংশটুকুই দেখা যায়।

জানা যায়, একটি জীর্ণ প্রতিষ্ঠা-লিপি ছিল বেদীর দেওয়ালে। পরিতাপের বিষয়, চাপা পড়ে গিয়েছে লিপিটিও। তবে, লিপির বয়ানটি সেবাইত পরিবার টুকে নিয়েছিলেন। আমরাও সেটি সংগ্রহ করেছি। তা থেকেই জানা গিয়েছে—জনৈক বোধিরাম (কিংবা বুধিরাম) সাহা বাংলা ১২৮৪ সনে মন্দির নির্মাণ শুরু করে প্রয়াত হন। জনৈক ধর্মপ্রাণ হিতাকাংখী শীতল সাহা ধন-রত্ন দিয়ে সাহায্য করলে, বোধিরামের বিধবা পত্নী ছনিয়াঁ দেবী পরের বছর ১২৮৫ সনে, মন্দিরের নির্মাণ শেষ করেছিলেন। অর্থাৎ দেড়শ’ বছর আয়ু পূর্ণ হতে চলেছে মন্দিরটির।
আমরা প্রথমেই বলেছি, মন্দিরটি একটু বিশেষ রীতির। বর্গাকার বা আয়তাকাব নয়, এটি নির্মিত হয়েছে ছয়-কোণা বা ষড়ভুজ আকারে। ভিত্তিবেদী, তার উপরের প্রদক্ষিণ-পথ, কিংবা মন্দিরসৌধের সর্বাঙ্গ ছয়-কোণা গড়নে তৈরি করা হয়েছে। এই জেলায় এমন কারিগরীর মন্দির আর দ্বিতীয় নাই।
পশ্চিম দিকের দ্বারপথ ছাড়া, বাকি পাঁচটি দেওয়ালে পাঁচটি প্রতিকৃতি-দ্বার রচিত হয়েছে। প্রতিটি দ্বারের দু’পাশে একটি করে স্তম্ভ দেখা যায়। অনুরূপ প্রতিকৃতি দ্বার দেখা যায় ভিতরে গর্ভগৃহের পাঁচটি দেওয়ালেও। মূল দ্বারপথটি সহ সবগুলি দ্বারই রচিত হয়েছে দরুণ-রীতির খিলান-এর সাহায্যে।

মন্দিরের মাথায় চালা-ছাউনি দেওয়া। দ্বিতলটি সংক্ষিপ্ত নয়, প্রমাণ সাইজের। ছাউনির সবগুলি চালই হস্তিপৃষ্ঠের মত উত্তল আকারে নির্মিত। এটিও বেশ অনন্য করে তুলেছে সৌধটিকে। কার্ণিশের বঙ্কিম ভাবটি চোখে পড়বার মতো।
শীর্ষক বা চুড়ায় বেঁকি, আমলক, কলস, ত্রিশূল-দণ্ড বেশ সুচারুভাবে সাজানো। তাছাড়া, নিয়মিত সংস্কার আর বর্ণলেপনের ফলে, সর্বক্ষণ সুন্দর-দর্শন হয়ে থাকে সৌধটি। জীর্ণতার চিহ্নটুকুও নাই কোথাও। সেবাইত পরিবারের সদা সতর্ক দৃষ্টি নিরাপদ করে রেখেছে দেবালয়টিকে। সাক্ষাৎকারঃ শ্রী ওমপ্রকাশ মুরারকা, কর্ণেলগোলা।
পথ-নির্দেশঃ শহরের গোলকূয়া চক থেকে পূর্বমুখে সামান্য এগিয়ে কর্ণেলগোলা চক। এবার উত্তরে দু’পা দূরেই, একদিকে মুরারকা পরিবারের বসতবাড়ি, আর অন্যদিকে অনিন্দ্য সুন্দর মন্দিরটি অবস্থিত।

- Advertisement -
Latest news
Related news