নিজস্ব সংবাদদাতা: মিনিট খানেক আগেই ঘোষণা হয়েছে ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে থ্রু-ট্রেন যাবে। যাত্রীরা যেন নিরাপদ দূরত্বে থাকেন। থ্রু-ট্রেন মানে একটা মাল গাড়ি তখন ছুটে আসছে কলকাতার দিক থেকে খড়গপুরের দিকে। সেই ট্রেনকে সবুজ ঝান্ডা দেখানোর জন্য প্ল্যাটফর্মেই অবস্থিত নিজের কার্যালয় থেকে ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এলেন রেলকর্মী সতীশ কুমার।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/06/Screenshot_20220623-132620_Video-Player.jpg)
ট্রেন তখন স্টেশন থেকে ঠিক ৩০ সেকেন্ডের দূরত্বে। সতীশ কুমারের হাতে তখন উঠে এসেছে সবুজ ঝান্ডা। ওই ঝান্ডা দেখে চলন্ত ট্রেনের চালক গাড়িটি গড়িয়ে যাবেন পরম নিশ্চিন্তে, আকাঙ্খিত গতিতে। কিন্তু তখুনি সতীশ কুমারের নজরে পড়ল ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম আর আপ লাইন ঘেঁষে পড়ে রয়েছেন এক বৃদ্ধ ভিক্ষাজীবী, ওঠার চেষ্টা করেও উঠতে পারছেননা।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/06/Screenshot_20220623-132658_Video-Player.jpg)
ওদিকে তীব্র হর্ন বাজিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে মালগাড়িটি। হয়ত কয়েক মিলিসেকেন্ড ভাবতে সময় নিয়েছিলেন সতীশ কুমার। তারপর হাতের সবুজ ও লাল ঝান্ডা দুটি প্ল্যাটফর্মেই ছুঁড়ে ফেলে ট্রেন লাইনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। পাঁজাকোলা করে ভিক্ষাজীবীকে তুলে নিয়ে গেলেন আপ আর ডাউন লাইনের মধ্যবর্তী নিরাপদ দূরত্বে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড জোরে হর্ন বাজিয়ে স্টেশন কাঁপিয়ে পের হয়ে গেল প্রায় ৬০কিলোমিটার প্রতিঘন্টায় থাকা মালগাড়িটি। ইতিহাস হয়ে গেলেন সতীশ কর্মী। হাওড়া-খড়গপুর শাখার বালিচক স্টেশনে সেই ইতিহাস রচনা হল বৃহস্পতিবার সকাল ৫.২৯ ।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/06/Screenshot_20220623-132707_Video-Player.jpg)
বালিচক স্টেশন ম্যানেজার দশরথ বৈরাগী জানিয়েছেন, “সতীশ আমাদের মানে রেলকর্মীদের বুকের পাটা আরও বড় করে দিল তার সাথে এটাও জানিয়ে দিল কর্তব্যের বাইরেও মানুষের কর্তব্য থাকে। আমরা সবাই আরও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার মন্ত্র পেলাম ওর কাছ থেকে। আজ ভোর থেকে কী ভালো লাগছে আপনাদের বলে বোঝাতে পারবনা। বারবার সিসিটিভি ফুটেজটা দেখছি আর সতীশের বীরত্বে শিউরে উঠছি। এই সময় আমাদের নার্ভ কাজ করেনা, মাথা কাজ করেনা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। কিন্তু ফ্র্যাকশন অফ সেকেন্ডে সতীশ যে ভাবে নির্ভুল নিশানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই ভিক্ষাজীবীর প্রাণ বাঁচালো তা অকল্পনীয়, দুধর্ষ। আমি আমার উচ্চতর আধিকারিকদের কাছে আবেদন জানাবো যেন সতীশ কুমারকে উপযুক্ত মর্যাদায় পুরস্কৃত করা হয়।”
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/06/Screenshot_20220623-132802_Video-Player.jpg)
কী হয়েছিল? জানা গেছে রেলের পয়েন্টস ম্যান (এ) পদমর্যাদায় কর্মরত খড়গপুর রেল আবাসনের বাসিন্দা সতীশ কুমাররা বিভিন্ন স্টেশনে কাজ করে থাকেন। জকপুর থেকে রাধামোহনপুর বা আরও অন্য কোনও স্টেশন, যখন যেখানে ডিউটি পড়ে। গত কয়েকদিন ধরে বালিচক স্টেশনেই ডিউটি করছিলেন তিনি। বুধবার নাইট ডিউটি ছিল তাঁর। ওইদিন রাত ১০টা থেকে আজ অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা অবধি ডিউটি। এরই মধ্যে সকাল ৫.২৯ মিনিটে বালিচক স্টেশন দিয়ে যাওয়া একটি বিসিএন/ভিজেডএম ( Goods Train Category BCN/VZM) মালগাড়িকে পতাকা দেখাতে প্ল্যাটফর্মে আসেন তিনি।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/06/IMG-20220623-WA0006.jpg)
ট্রেনটি যখন পশ্চিমের কেবিন ছাড়িয়ে ডেবরা-পটাশপুর রাজ্য সড়কের ওপরে থাকা লেবেলক্রসিং পেরিয়েছে তখনই এক বৃদ্ধ ভিক্ষাজীবী যিনি কিনা বসে বসেই হাতের উপর ভর দিয়ে চলাফেরা করেন তিনি অন্যমনস্কতা বশত পড়ে যান প্ল্যাটফর্ম থেকে নিচে! ৩১ বছরের সতীশ কুমার তখন ঝুঁকে পড়ে ট্রেনটি দেখেছিলেন। ওই ভিক্ষাজীবীর কাছ থেকে তার দূরত্ব ছিল ৫০ মিটার। মুহূর্তে তিনি দৌড়ে যান, হাতের পতাকা ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়েন লাইনে। কোলে করে তুলে সরিয়ে আনেন ওই বৃদ্ধকে। প্ল্যাটফর্মে থাকা এক যাত্রী সতীশ কুমারকে ছুঁড়ে দেন পতাকা দুটি। সতীশ কুমার সেই পতাকা লুফে নিয়ে ট্রেনের চালককে দেখান। ট্রেনটি বেরিয়ে যায়।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/06/Screenshot_20220623-132856_Video-Player.jpg)
এই অভূতপূর্ব ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরই রেলকর্মী সতীশ কুমারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় উপচে পড়েছেন বালিচকের বাসিন্দারা। রোজ রোজ যেখানে শুধু সরকারি কর্মীদের ফাঁকিবাজী, কর্তব্যহীনতা আর দুর্ব্যবহারের খবরে খবর কাগজের পাতা ভরে ওঠে তখন নিজের জীবন তুচ্ছ করে আরেকটি জীবনকে বাঁচানোর জন্য সতীশ কুমারের এই উদ্যোগ মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে এখনও মানুষের জন্য মানুষ আছে, সতীশ কুমাররা আছে।
ঘটনায় নিজেদের পরম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বালিচক স্টেশন উন্নয়ন কমিটির যুগ্ম সম্পাদক কিংকর অধিকারী এবং বিশ্বজিৎ ভূঁইয়া বলেন, ” আজ বালিচক রেল স্টেশনে রেলকর্মী সতীশ কুমার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে একটি অসহায় মানুষের প্রাণ রক্ষা করল তা বর্তমান সমাজে অত্যন্ত বিরল একটি ঘটনা। আমরা বালিচক স্টেশন উন্নয়ন কমিটির পক্ষ থেকে তাঁর এই সাহসী এবং নিঃস্বার্থ ভূমিকায় গর্বিত। আমরা তাঁর এই ভূমিকার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। যদিও তাঁর এই কাজের জন্য কোন অভিনন্দনই যথেষ্ট নয়।”
রাধামোহনপুরের বাসিন্দা সমাজসেবী শিক্ষক দুরন্ত কুমার দাস বলেছেন, ” এক সময় ফৌজে ছিলাম। প্রাক্তন ফৌজি হিসাবে আজও গর্ব করি কিন্তু সতীশ কুমার আমাদের দেখিয়ে দিলেন আমজনতার মধ্যেও কত ফৌজি আছেন, কত দেশপ্রেমিক মানুষ আছেন। সতীশ কুমার যেভাবে ওই অসহায় ভিক্ষুককে রক্ষা করলেন তা একজন সেনার দক্ষতার থেকে কোনও অংশে কম নয়। ওনাকে আমার স্যালুট।” লাজুক সতীশ কুমার অবশ্য এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়াই দেখাতে রাজি ছিলেননা। অনেক সাধাসাধির পর তিনি শুধু একটা কথাই বলেছেন, ” আমি কিছুই করিনি। আমার মনে হয় এটা সবাই করবে। ওই মুহূর্তে মানুষটিকে বাঁচানোই আমার প্রধান কর্তব্য মনে করেছি এবং তাই করেছি।”