নিজস্ব সংবাদদাতা: মাঠ জুড়ে পোঁতা হয়েছিল লালঝান্ডা আর তার পাশেপাশে মাঠ জুড়ে সবুজ ধানের চারা রোপন করলেন কৃষক রমণীরা। এ যেন এক অবিশ্বাস্য কান্ড! রবিবার আকাশ ভাঙা বৃষ্টি ছিল দুই মেদিনীপুরেই। আর সেই বৃষ্টির অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন কৃষকের দল। বাঁধ ভাঙা উল্লাসে ধানের চারা নিয়ে ক্ষেতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কৃষক রমণী দল। ১৩ বছর পর ফের নিজেদের জমির দখল নিল পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকটি কৃষক পরিবার। মায়ের সঙ্গে জমি দাপিয়ে খেলতে দেখা গেল শিশুদের। জমির আলে দাঁড়িয়ে তখন প্রহরায় কয়েকশ কৃষক,তাঁদেরও হাতে লালঝান্ডা!
ঘটনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরি থানার টিকাশি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার উত্তর কলমদান গ্রাম। প্রান্তিক কৃষক রাসবিহারী মাইতি সহ পাঁচজন চাষী তাদের ১ একর ২৯ ডিসিমেল জমির পুনর্দখল নিলেন। শুধু তাই নয় এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ওই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এরকম বেদখল হওয়া জমি নিজেদের দখলে নেওয়ার লড়াইয়ে মাঠে নেমে পড়ল গরিব চাষী, বর্গাদার পাট্টাদাররা। চলতি কৃষি মরসুমেই নিজের জমি করব চাষ শ্লোগান দিয়ে তৈরি হচ্ছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার আরও হাজার হাজার কৃষক। এমনটাই জানালেন সারাভারত কৃষক সভার নেতৃত্ব।
এদিন ১৩ বছর পরে নিজের জমিতে ধান রোপন করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে গুরুপদ মাইতি, জোৎস্না মাইতিদের। টিকাশি গ্রাম পঞ্চায়েতের উত্তর কলমদান মৌজায় ৩৮২, ১২০২ ২৩৭০ এর খতিয়ানে ১৬৭২ দাগে ১ একর ২৯ ডিসমিল জমির মালিক গুরুপদ কিংবা জোৎস্নার পাশাপাশি রাসবিহারী মাইতি, সুকুমার মাইতিদেরও। জ্যোৎস্না জানিয়েছেন, ২৬ বছর ধরে ওই জমির চাষ করে আসছিলাম আমরা। আমাদের নিজেদের রায়ত জমি। কিন্তু ২০০৯ সালে নন্দীগ্রামের দিক থেকে আসা সশস্ত্র বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমাদের ওপরের। এরপর থেকে আমাদের সমস্ত জমির দখল নেয় ওরাই। ওদের তীব্র অত্যাচারেরা পুরুষরা সবাই গ্রাম ছাড়া হয়ে যায়। ২০১১ সালে তৃনমূল ক্ষমতায় আসার পর অত্যাচার আরও বাড়ে। এরপর আর জমির ধারে কাছে ঘেঁষতে পারিনি আমরা। আজ ১৩ বছর পর সেই জমিতে চাষ করতে পারলাম আমরা।”
এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের ওই একই মৌজার ৫ জন পাট্টাদার শ্রীকান্ত মন্ডল, ভরত বারুই, প্রতাপ বারুই, তাপস বারুই, মনোরঞ্জন দীক্ষিত নিজেদের বেদখল হওয়া ৫৪ ডিসমিল জমিতে নেমে পড়ে ধানের চারা নিয়ে। রবিবার তাঁরাও নিজের জমিতে চারা পুঁতে জমির অধিকার নেয়। ভরত, শ্রীকান্তরা জানিয়েছেন, গত ১৩ বছর ধরে নরকযন্ত্রনা ভুগেছি আমরা। শুধুই জমি বেহাত হয়ে গেছিল এমনটা নয় ২০০৯ সালের ৮ ই জুন নন্দীগ্রামের কায়দায় খেজুরি দখলে নেমে পড়ে গোলাগুলি, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তৃণমূলী জল্লাদ বাহিনী তীব্র সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছিল খেজুরিতে। বহু মানুষকে ঘরছাড়া, মারধর, খুন, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, ঘর পুড়িয়ে দেওয়া থেকে লুটপাট জরিমানা, মহিলাদের সম্মান নষ্টর সাথে সাথে জোরপূর্বক নিজের রায়ত জমি, বর্গাদার, পাট্টাদারদের জমি, বেদখল করে নেয় লুটেরা বাহিনী।
কিন্তু কী করে এটা সম্ভব হল? উত্তরে কৃষক সভার নেতা হিমাংশু দাস জানিয়েছেন,” সারা রাজ্যের সাথে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা জুড়ে লুটের পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে, ডেপুটেশন, বিক্ষোভ- অবস্থান- কর্মসূচি শুরু হয়েছে । অনুরূপ খেজুরি ব্লক এলাকার প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে ও পঞ্চায়েত সমিতিতে বঞ্চিত- প্রতিবাদী মানুষের বিশাল বিশাল মিছিল ডেপুটেশন অবস্থান কর্মসূচি গুলি সংঘটিত হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে লুটের খতিয়ান প্রশাসনের কাছে। দাবি উঠেছে বেদখল জমি আর বঞ্চিত মানুষের অধিকার ফিরে পাওয়ার। চাপে পড়ে তৃণমূলীরা এখন দিশেহারা। গ্রামে গ্রামে মানুষ জাগছে। চুরি দুর্নীতিতে জড়িয়ে তৃণমূল নেতারা এখন মুখ লুকাচ্ছে। খেজুরিতেও তার ব্যতিক্রম নয়। মানুষ এক যুগ ধরে তৃনমূলের অত্যাচার সহ্য করেছে এবার রুখে দাঁড়িয়েছে তাঁরা। নিজেদের আইনি জমির দখল নিয়েছেন।
রবিবার সকাল থেকেই স্থানীয় কৃষক- খেতমজুর সংগঠনের নেতা হারাধন জানা, অসিত সামন্ত, সঞ্জয় দলুই এর নেতৃত্বে গ্রাম এলাকায় যেমন চাষিরা দল বেঁধে লালঝান্ডা হাতে ঘিরে ফেলে ওই সব জমির আল। খেজুরী ব্লক এলাকায় কৃষক নেতা যাদবেন্দ্র নাথ সাহু, সমীরেন্দ্রনাথ কলা, গোকুল ঘড়ুই, রাম কুমার মাইতি, জাহারাজ আলীদের নেতৃত্বে আরও একদল প্রহরায় থাকে নিজেদের জমিতে ধান রোপন করা কৃষকদের। খেজুরির পঞ্চায়েত সমিতি প্রাক্তন সভাপতি ও খেতমজুর নেতা হিমাংশু দাস জানিয়েছেন,” খেজুরিতে গরিব কৃষক, পাট্টাদার, বর্গাদার মানুষ তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াই শুরু হয়েছে। এই লাল ঝান্ডার লড়াই এবার ছড়িয়ে পড়বে বাংলা জুড়েই। আগামী দিনে এরকম হাজার হাজার একর বেদখল জমি উদ্ধার করে গরিব মানুষ তাদের অধিকার ফিরে পাবেন লাল ঝাণ্ডার নেতৃত্বে। আর যে মানুষকে ভয় দেখিয়ে, ধমকে চমকে রোখা যাবেনা তারই প্রমাণ দিল খেজুরি।”