বিশেষ সংবাদদাতা: অন্য কেউ নয়, একমাত্র সন্তান দেবযানীকে খুনের চেষ্টা করেছিল বাবাই? শুক্রবার রাতে বলিচক স্টেশন থেকে উদ্ধার হওয়া বাবার মুণ্ডু চ্যুত দেহ উদ্ধার করেছিল রেলপুলিশ আর মেয়েকে ক্ষত বিক্ষত গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করেছিল স্থানীয় বাসিন্দারা। গোটা ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেছিলেন স্টেশন লাগোয়া হামিরপুর এলাকার লোকজন। কেনই বা ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা করলেন আর প্রায় একই সময়ে কারা তাঁর মেয়েকে ছুরি মারল তাই নিয়ে ধন্দ ও আতংক ছড়িয়ে ছিল।
![](http://kgpbangla.in/wp-content/uploads/2022/09/Screenshot_20220924-145818_PicsArt.jpg)
কিন্তু কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মোটামুটি চিত্রটা যেন কিছুটা পরিষ্কার হচ্ছে। পারিপার্শ্বিক তথ্য প্রমানাদি এও ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বছর কুড়ির দেবযানীকে খুনের চেষ্টা করে থাকতে পারেন তাঁর বাবা কমল সেনও। পর্যাপ্ত উপার্জন না থাকা এবং কমল সেনের কিছুটা মানসিক সমস্যার জন্য সংসারে অশান্তি থেকেই এমন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
নিজস্ব সূত্র মারফত ‘KGP বাংলা’ জানতে পেরেছে কমল সেন তাঁর একমাত্র মেয়ে দেবযানীকে নিয়ে মাঝে মধ্যেই সান্ধ্যকালীন ভ্রমনে বেরুতেন। সেই মত শুক্রবারও তিনি বেরিয়ে ছিলেন কিন্তু এদিন তাঁর হয়ত লক্ষ্য ছিল মেয়ে কে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করবেন। মেয়ে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে বাবা একটি ধারালো অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন। জানা গেছে মেয়েকে তিনি বলেন আজ পশ্চিম দিকে শিবমন্দিরে যাবেন। সেই মত বাবা ও মেয়ে যায়। এরপর বাবা মেয়েকে বলেন, সামনের দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে লাইনগুলো টপকে প্ল্যাটফর্মের বাইরে বেরিয়ে যাবেন তাঁরা। অন্ধকার ছিল, মেয়ে আগে যাচ্ছিল বাবা পেছনে। এরপর হঠাৎই মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন এবং ওই ধারালো অস্ত্র নিয়ে মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। আঘাতের পর আঘাত করতেই থাকেন। নিজেকে বাঁচানোর প্রবল চেষ্টায় দুই হাত ক্ষত বিক্ষত হয় মেয়ের তারপর দেবযানী লুটিয়ে পড়েন। মেয়ে মারা গেছে মনে করেই কমল ঘটনা স্থল ছেড়ে চলে যান এবং আরও একটু এগিয়ে গিয়ে চলন্ত ট্রেনের নিচে গলা পেতে দেন।
আসলে দেবযানী অন্ধকারে স্পষ্ট করে বুঝতেও পারেননি যে তাঁর বাবাই তাঁকে খুন করার চেষ্টা করছে। কমল চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পরে সম্বিৎ ফেরে দেবযানীর। এরপরই জায়গা ছেড়ে লোকালয়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকে ‘ বাঁচাও, বাবাকে বাঁচাও বলে।’ কারন দেবযানীর ধারনা ছিল তাঁকে খুন করার চেষ্টা করছিল যে দুষ্কৃতীরা তারা তাঁর বাবাকে কোথাও নিয়ে গেছে এবং বাবাকেও খুন করবে তারা।’ দেবযানী কে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছিল এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী রঞ্জিত ঘোষ বলছেন, ” আমার বাড়িও রেল লাইনের পাশে, ঘটনাস্থলের কাছাকাছি। মহিলা কন্ঠে বাঁচাও বাঁচাও আওয়াজ শুনে প্রথমে আমাদের মনে কোনও দুষ্কৃতীদল কোনও মেয়েকে তুলে নিয়ে এসেছে দুষ্কর্ম করার জন্য। বেশ কয়েক বার আওয়াজটা হতে আমরা এক পা দু পা করে এগিয়ে যাই। অন্ধকারে বুঝতে পারি একটা মেয়ে বসে আছে। তাকে তুলে এনে আলোর কাছে নিয়ে গিয়ে দেখি গোটা মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। গোটা শরীরের ধারালো অস্ত্রের আঘাত। তার মুখ মুছিয়ে দেই। তারপর চিনতে পারি সেনেদের বাড়ির মেয়ে বলে। মেয়েটি বলে তাঁর বাবাও সঙ্গে ছিল। অন্যদিকে পালিয়ে গেছে। তখন আরও একটু এগিয়ে গিয়ে আমরা অবাক হয়ে দেখি ভদ্রলোক আত্মহত্যা করেছেন। যদি কেউ তাঁকে তাড়া করবে তিনি আত্মহত্যা করবেন কেন?”
সন্দেহ আরও প্রকট হয়েছে ডেবরা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে এবং উদ্ধারকারীদের দেওয়া মেয়েটির বয়ানে। মেয়েটি বলছে, আমি সামনে যাচ্ছিলাম। বাবা আমার পেছনে। হঠাৎই আমাকে পেছন থেকে কেউ ঠেলে দেয়। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাই। একজন আমাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারতে থাকে। আমি ঘুরে গিয়ে তাকে আটকানোর চেষ্টা করি। লোকটার চেহারা আমার বাপীর মতই কিন্তু তার মুখে মাস্ক থাকায় আমি চিনতে পারিনি। ঘটনাস্থলে ওই একজনই দুষ্কৃতী ছিল।” তাহলে কী মেয়েকে সামনে এগিয়ে দিয়ে কমল বাবু পরে মাস্ক পরে নেন? কারন আগে থেকে মাস্ক পরে থাকলে মেয়েতো বুঝতে পারত।
পুলিশের বক্তব্য একজনের পক্ষে বাবাকে সরিয়ে মেয়েকে মারা সম্ভব নয়। তাছাড়া কাছেই লোকালয়, মেয়ে আক্রান্ত জানলে বাবা লোকালয়ের দিকে না গিয়ে উল্টো দিকে যাবেন কেন? কেন আত্মহত্যা করবেন? পুলিশের আরও মনে হচ্ছে, বাড়ির লোকেরা কিছু একটা লুকাতে চাইছে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ” দেবযানী রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত নিয়ে এম.এ করছে। সেকেন্ড সেমিস্টারের জন্য অনলাইন ফর্ম ফিলাপ করতে সে সন্ধ্যাবেলায় বলিচক বাজারে যায় কিন্তু কম্পিউটার সেন্টার বন্ধ থাকায় সে বাড়ি ফিরছিল। এই সময় বাবার ফোন আসে। বাবা তাঁকে ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ডেকে নেন। ওই প্ল্যাটফর্ম বরাবর খড়গপু্রের দিকে এগিয়ে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের ঢালু অংশ দিয়ে নেমে ডানদিকে চারটে লাইন পেরিয়ে নিজেদের বাড়ির রাস্তা ধরার মুখেই ঘটনাটি ঘটে। কিন্তু কেন বাবা মেয়েকে খুন করতে যাবে? জবাব মিলেছে তারও। জানা গেছে ইদানিং কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ছিলেন কমল সেন। এমনিতে পারিবারিক কাটা পোশাকের দোকান থাকলেও কমল খুব একটা তাতে বসতেন না।
কমল সেন অঙ্কের প্রাইভেট টিউশনি করতেন। খুবই নাম ডাক ছিল তাঁর। কিন্তু গত তিন/চার বছর টিউশনির বাজার খারাপ যাচ্ছিল। সংসারে টানাটানি চলছিল। কখনও কখনও কাজ করছিল না মাথাও। যে অভিভাবক মাসের বেতন দিয়ে দিয়েছেন তাঁর কাছে গিয়েও বারবার টাকার জন্য তাগাদা দিয়েছেন। মানুষ বুঝতে পেরেছে সেন স্যারের ‘ মাথার সমস্যা’র কথা। টিউশন আরও কমেছে। বাড়িতে টুকটাক অশান্তি হত তবে শুক্রবার তেমন কোনো অশান্তি হয়েছিল কী? স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। ডেবরা পুলিশ যদিও এখনও এই বিষয়ে কিছুই বলেনি। রেল পুলিশ আর রেল সুরক্ষা বাহিনীর মতে কমল সেন আত্মহত্যা করেছেন এটা নিশ্চিত কিন্তু বাকি ঘটনা তদন্ত স্বাপেক্ষ। ঘটনা স্থলে গিয়েছিলেন ডেবরা পুলিশের আধিকারিকরাও। পুলিশ এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে নারাজ। সমস্ত সম্ভবনা তাঁরা খতিয়ে দেখছেন বলে জানান এক পুলিশ আধিকারিক। আপাতত পুলিশ সেই অস্ত্রটি খুঁজছে যা দিয়ে মেয়েকে আঘাত করা হয়েছিল। তা উদ্ধার হলেই ঘটনা অনেকটাই জলবৎ তরলং হয়ে যাবে বলে পুলিশের ধারণা।