নিজস্ব সংবাদদাতা: বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেছে প্রায় ১ বছর আগে। তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছে তৃনমূল কংগ্রেস। কিন্তু নির্বাচনোত্তর প্রতিহিংসার মাশুল এখনও গুনতে হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভ্য সমর্থকদের। পুলিশ এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের আধিকারিকদের কাছে অভিযোগ করলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়নগড় থানা এলাকার বিজেপি নেতা কর্মীরা। অভিযোগ চাষবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাঁদের, খুলতে দেওয়া হচ্ছেনা দোকান। অভিযোগ আরও যে কোথাও পুকুর আবার কোথাও দখলিকৃত জায়গা থেকে বিরোধীদের স্বত্ত্ব উৎখাত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অভিযোগ আরও যে এই সব রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাত থেকে রেহাই পেতে আইনের দ্বারস্থ হয়েও কোনও লাভ হয়নি উল্টে আইনের রক্ষক পুলিশ নাকি ওই বিরোধী নেতা কর্মীদের শাসকদলের নেতাদের কাছে গিয়ে সমস্যা মেটানোর পরামর্শ দিচ্ছে। যদিও শাসকদল কিংবা পুলিশ উভয় তরফ থেকেই এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলা হচ্ছে।
ঘটনা নারায়নগড় থানা এলাকার গ্রামরাজ গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন সানদেউলি গ্রাম। উল্লেখ্য সানদেউলি গ্রাম বীরবিরা বলেও পরিচিত। এই সানদেউলি গ্রামের নান্টু কুইল্যা, অরুণ দোলই, টেপরী ঘোড়ই, চন্দন কুইল্যা, মুকুন্দ মাইতি প্রমূখরা পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার, মহকুমা শাসক ইত্যাদিদের কাছে লিখিত ভাবে অভিযোগ জানিয়ে বলেছেন, যে বিজেপি করার অপরাধে এঁদের জমি চাষ করতে দিচ্ছেনা শাসকদলের কিছু নেতা ও কর্মী। জমিতে শ্রমিক নামতে বারণ করা হয়েছে, জলসেচের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সংযোগের তার কেটে নেওয়া হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। অভিযোগ, এই বয়কটের কথা পুলিশ প্রশাসনকে বার বার জানানো হলেও কোনও সুরাহা হয়নি। উল্টে পুলিশ আধিকারিকরা তৃণমূলের অফিসে গিয়ে নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে মিটমাট করে নেওয়ার কথা বলছেন!
নান্টু কুইল্যা অভিযোগ করেন, ঘটনার সূত্রপাত বিধানসভা নির্বাচনের ফল বের হওয়ার পর থেকেই। জয়ের পর থেকেই বেছে বেছে বিজেপি কর্মী সমর্থকদের বাড়িতে তান্ডব শুরু হয়। আমি বিজেপির নির্বাচনী কনভেনার ছিলাম। আমার বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। তীব্র সন্ত্রাসের মুখে আমরা কয়েকটি পরিবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হই। কয়েকমাস পরে হাইকোর্টের নির্দেশে বাড়ি ফেরানোর কাজ শুরু করে পুলিশ। পুলিশের আশ্বাস পেয়ে যখন আমাদের এক দুজন করে বাড়ি ফেরা শুরু হয়েছে তখনই সদ্য বাড়ি ফেরা এক বিজেপি কর্মীকে মেরে পা ভেঙে দেওয়া হয়। থমকে যায় বাড়ি ফেরার প্রক্রিয়া। আবারও পুলিশ যোগাযোগ করে বাড়ি ফিরতে বলে। আশ্বাস দেয় আর কিছুই হবেনা। সেই মত গত ছ’মাস আগে সবাই বাড়ি ফিরে আসে। এরপর শুরু হয় ‘সারেন্ডার’পালা। হয় তৃনমূলের পতাকা ধর, নয় না খেয়ে মর। যারা তৃনমূলের পতাকা ধরতে রাজি হয়নি তাঁদের চাষবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
নান্টু কুইল্যা আরও অভিযোগ করেছেন, তিনি বাড়ি সংলগ্ন জায়গা থেকে তুষের ব্যবসা করতেন সেটিও বন্ধ করা হয়েছে। এমনকী বাড়ি ঘর সরানোর মিস্ত্রী আসতে দেওয়া হচ্ছেনা। পাশাপাশি যে পুকুরকে ঘিরে তাঁদের বসবাস এবং যে পুকুরটি তাঁদের জীবিকার অন্যতম অবলম্বন সেই পুকুরে মাছ চাষ করা থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে তাঁদের। ভোটের সময় নিজের বাড়িতে বিজেপি পতাকা লাগানোর অপরাধে এক পুরোহিতের দখলে থাকা বেশ কিছু পরিমান জমিও জোর করে দখল নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ বিজেপি নেতা কর্মীদের। এই সমস্ত অভিযোগই আনা হয়েছে নারায়নগড় ব্লক তৃনমূলের সাধারণ সম্পাদক বিমল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে। বীরবিরা গ্রামেই বাড়ি শ্রী ভূঁইয়ার। অভিযোগ তাঁরই নেতৃত্বে এই প্রতিহিংসার রাজনীতি চালাচ্ছে শাসকদল।
ঘটনাটিকে সর্বৈব্য মিথ্যা বলে দাবি করেছেন তৃনমূলের নারায়নগড় সাধারণ সম্পাদক বিমল ভূঁইয়া। ভূঁইয়া বলেন, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির আপাত ভালো ফল হওয়ার পর আমাদের এলাকার বিজেপি নেতৃত্ব যে রাজ্যের ক্ষমতাই দখল করে নিয়েছে এমন আচরণ করতে শুরু করেন। তাঁদের হম্বিতম্বি, আচার আচরণ এলাকার কিছু মানুষকে রুষ্ট করেছিল। সেই মানুষদেরই কেউ কেউ ২০২১ নির্বাচনের পর হয়ত ওই বিজেপি নেতা কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। কিন্তু সেটা ছিল একটা সাময়িক বিষয় যা কাটিয়ে এলাকাকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাইছি আমরা। সেই প্রক্রিয়াটিকে বাধা দেওয়ার লক্ষ্যে, এলাকায় বিভাজনের রাজনীতি অব্যাহত রাখার জন্যই কেউ কেউ এই কাজ করছেন। যাঁরা জমি চাষ করতে পারছেননা বলে দাবি করছেন তাঁদের বেশিরভাগটাই বাইরে থাকেন এবং এলাকায় অন্যকে জমি ভাগে দিয়ে চাষ করান।
ভূঁইয়া বলেন, ‘ কারও জলসেচের বিদ্যুৎ সংযোগ আমরা ছিন্ন করিনি। উনি বিদ্যুতের বিল মেটাননি হয়ত। দ্বিতীয়ত: যে পুকুরের স্বত্ত্ব থেকে অভিযোগকারীদের বঞ্চিত করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে সেই পুকুরটি দিনের পর দিন ভোগ করার পরেও তার নির্ধারিত রাজস্ব পঞ্চায়েতকে দেওয়া হয়নি। পঞ্চায়েত তাই ওই এলাকারই অন্যদের চাষ করতে বলেছে। আর পুরোহিতের জমি বলে যা প্রচার করা হচ্ছে তা সরকারের খাস জমি। গ্রামের মন্দির লাগোয়া ওই জমিটি মন্দিরকে আচার উৎসবের জন্য প্রশস্ত করা হয়েছে। কারন স্থান সঙ্কুলানের অভাব হচ্ছিল।’
নারায়নগড় পুলিশের তরফেও অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, বাড়ি ফেরানো থেকে কৃষিকাজ স্বাভাবিক করার জন্য পুলিশ কাজ করেছে এবং করছে। রাজনৈতিক নয়, কোথাও কোথাও ব্যক্তিস্বার্থ, দুই বিপরীত নেতৃত্বের ইগো ইত্যাদির ফলে হয়ত কোথাও কোথাও সামান্য সমস্যা থেকে যাচ্ছে। সেটিকেও মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশের এক আধিকারিক বলেছেন, ‘ কাউকেই কোনও রাজনৈতিক নেতার দ্বারস্থ হতে বলা হয়নি। বলার প্রশ্নও নেই। নির্ভয়ে চাষ করুন পুলিশ সমস্ত রকম সাহায্য করবে।’