নিজস্ব সংবাদদাতা: তৃনমূলের টিকিট না পেয়ে বিজেপি কিংবা বিজেপির টিকিট না পেয়ে তৃনমূলে যাওয়াটা আর নতুন কিছু নয়। গত বিধানসভাতেই এই কান্ড দেখে দেখে চোখ পচে গেছে বঙ্গবাসীর। তা বলে তৃনমূল থেকে বামফ্রন্টে? হ্যাঁ, এবার আদা কাঁচকলার সেই মিলনও দেখল পুরনির্বাচন। রাজ্যের ১০৮টি পৌরসভার সাথে পশ্চিম মেদিনীপুরের ৭টি পৌরসভায় নির্বাচন হতে চলেছে আগামী ২৭শে ফেব্রুয়ারি। সেই ৭ পৌরসভার একটি হল খড়গপুর। এই খড়গপুরেই দলের টিকিট না পেয়ে বামফ্রন্টে এসেছেন এক তৃনমূল কর্মী আর এসেই টিকিটও পেয়ে গেছেন। খড়গপুর পৌরসভার ১৭নম্বর ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট সমর্থিত সিপিআই প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন তৃনমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলর। এ হেন ঘটনায় চমকে উঠেছে খড়গপুর শহর। এ যে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খাওয়া! কারও কারও মতে তেলে জলে মিশে যাওয়া।
উল্লেখ্য ১৭নম্বর ওয়ার্ড খরিদা মালঞ্চ রোড এলাকায় বাম সমর্থিত সিপিআই প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন রীনা শেঠ। কাস্তে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এই রীনা শেঠকে এবার প্রথম তালিকায় ঠাঁই দিয়েছিল তৃনমূল। অনেকের মতে প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাকের তৈরি সেই প্রথম তালিকায় নিজের নাম তুলে নিতে সমর্থ হন রীনা কারন এই ১৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকেই ২০০৫ এবং ২০১০ সালে জিতে কাউন্সিলর হন রীনা। বলা বাহুল্য দু’বারই তৃনমূলের প্রতীকে জয়ী হন তিনি। ২০১৫ সালে এই আসনে তৃনমূলের হয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করেন খড়গপুর তৃনমূলের প্রভাবশালী নেতা মুনমুন বা দেবাশিস চৌধুরী। রীনা টিকিট পাননি। এবার সেই আসনটি ফের মহিলা সংরক্ষনের আওতায় চলে আসায় ওই আসনে আইপ্যাক ব্যান্ডে প্রার্থী তালিকায় নাম উঠে আসে রীনার। প্রথম তালিকায় তাই তাঁর নামই ছিল।
প্রথম তালিকায় অবশ্য বাদ পড়েননি দেবাশিস চৌধুরী। লাগোয়া ৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী করা হয় তাঁকে। যদিও প্রথম তালিকা প্রকাশের পরই শোরগোল শুরু হয়ে যায়। দলের মধ্যেই কথা উঠতে থাকে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে টিম পিকে দলের পুরানো কর্মী নেতাদের উপেক্ষা করেছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অনুগামীদেরই গুরুত্ব দিয়েছে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামীরা বঞ্চিত হয়েছেন। এমনকি দলের অভ্যন্তরে এও কথা ওঠে যে প্রার্থী নির্বাচনে টাকার লেনদেনও হয়েছে কোথাও কোথাও। তবে দল যে বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় তা’হল কৌশলী পিকে প্রার্থী নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দলে অভিষেক প্রাধান্য কায়েম করতে চাইছে। প্রথম তালিকা প্রকাশের মাত্র ১ঘন্টার মধ্যেই দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। প্রথম তালিকা দলীয় ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশ করা হয় আর দ্বিতীয় তালিকার নাম ওয়েবসাইটে তুলতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে ভেবেই এই তালিকাকেই আসল ও চূড়ান্ত প্রত্যয়িত করার জন্য পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সুব্রত বকসির স্বাক্ষর সম্বলিত করা হয়। ঘটনা হল প্রায় ৪৮ ঘন্টা ধরে প্রথম তালিকা দলের ওয়েবসাইটে থেকে যায় আর অন্যদিকে দ্বিতীয় তালিকা ধরে দেওয়াল লিখন, প্রচারের কাজ ও মনোনয়নের প্রস্তুতি চলতে থাকে। এই ডামাডোল তৃনমূল কংগ্রেসের ইতিহাসে প্রথম।
যাইহোক খড়গপুরের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ে যায় দেবাশিসের পাশাপাশি ২৮নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা খড়গপুর পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান রবিশঙ্কর পান্ডের নাম। পরিবর্তে দল এই দুজনকেই পুনর্বাসন দেয় তাঁদের স্ত্রীদের প্রার্থী করে। ঘটনাক্রমে এই দুজনের নিজস্ব ওয়ার্ড মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় প্রথম তালিকায় দুজনকেই লাগোয়া ওয়ার্ডে প্রার্থী করা হয়েছিল। দেবাশিসকে যেমন ৯ নম্বরে প্রার্থী করা হয় রবিশঙ্করকে তেমন প্রার্থী করা হয় ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে। পরিবর্তে তাঁদের নিজস্ব ওয়ার্ডে প্রার্থী করা হয় দলের মহিলা কর্মীদের। প্রথম তালিকায় ১৭ নম্বরে রীনা শেঠের মতই ২৮ নম্বরে প্রার্থী হন সমিতা দাস। দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায় বাদ গিয়েছেন দেবাশিস ও রবিশঙ্কর। পরিবর্তে তাঁদের নিজেদের যে ওয়ার্ড মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সেখানে প্রার্থী করা হয় দেবাশিস জায়া মিতালী চৌধুরী এবং রবিশঙ্কর জায়া রীতা পাণ্ডেকে। স্বাভাবিক ভাবেই বাদ পড়ে যান রীনা ও সমিতা। দ্বিতীয় তালিকায় যদিও সমিতাকে ২৬নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী করা হয়েছিল রীনাকে আর প্রার্থী করা হয়নি। যদিও দুই প্রার্থীই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং দল ছাড়েন।
সমিতা নিজের ওয়ার্ড ছেড়ে অন্য ওয়ার্ডে প্রার্থী হবেননা জানিয়ে দেন এবং কংগ্রেসে যোগ দিয়ে ২৮নম্বরের প্রার্থী হয়ে যান অন্যদিকে রীনা সিপিআইয়ে যোগ দিয়ে ১৭ নম্বরের প্রার্থী হন।দু’জনেই ক্ষোভের সঙ্গে জানিয়েছেন তৃনমূল তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁদের প্রার্থী করেছে তাঁদের একমাত্র যোগ্যতা তাঁরা নেতার স্ত্রী। দুজনেই নিপাট গৃহবধূ ও দলের কোনও কর্মকান্ডে কোনও দিনই যুক্ত ছিলেননা। তবে সমিতার তৃনমূল ত্যাগ ও কংগ্রেসে যোগদানে মানুষ ততটা অবাক হননি যতটা অবাক হয়েছেন রীনার সিপিআইয়ে যোগ দেওয়ায়। আর আরও অবাক হয়েছেন সিপিআই তাঁকে প্রার্থী করায়। মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন একটি বামপন্থী দল কী করে তৎকাল কর্মীকে যে কীনা আবার তৃনমূল থেকে আসা তাঁকে প্রার্থী করে? তাদের নিজেদের দলে কী কর্মীর অভাব পড়েছে?
সিপিআইয়ের এক খড়গপুর নেতা অবশ্য জবাব দিয়েছে, প্রয়াত বাম সাংসদ নারায়ন চৌবের এই ওয়ার্ডটির বর্তমান তৃনমূল নেতা কর্মীদের অধিকাংশই একদা সিপিআই করতেন। এমন কী তৃনমূল নেতা দেবাশিস চৌধুরীও। প্রয়াত সাংসদ ও তাঁর প্রয়াত সন্তান গৌতম চৌবের বাম বিচ্যুতির কারণেই ওই অংশটি প্রথমে ইউসিসি ও পরে তৃনমূল হয়ে যায়। তাই কেউ ওই এলাকায় তৃনমূল ছাড়লে তারা সিপিআইয়ে ফিরে আসে। এটা একটি স্থানীয় বাধ্যবাধকতা। আর দলের বেশিরভাগ অংশটাই প্রয়াত গৌতম চৌবের হাত ধরে তৃনমূলে চলে যাওয়ায় মহিলা প্রার্থী পেতে সিপিআইয়ের যথেষ্ট সমস্যা হচ্ছিল সেই সময় তারা রীনার প্রস্তাব পেয়ে তাঁকে প্রার্থী করেছেন। সিপিআইয়ের ধারণা দু’বারের কাউন্সিলর হওয়ার সুবাদে রীনার নিজস্ব কিছু ভোট পকেট রয়েছে।