নিজস্ব সংবাদদাতা: খেলার মাঠে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ লুটিয়ে পড়া পড়ুয়ার ঘটনাটা আমাদের সবারই জানা। তারপর তাকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যু। ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিতে দিতে চিকিৎসক বললেন, ‘ওকে খেলতে কেউ বারণ করেনি? ওর তো দৌড়ানো, খেলা বারণ করা উচিৎ ছিল।’ শিশুদের বারণ করলেই বা সে শুনবে কেন? নিজের বন্ধুদের খেলতে দেখে সে কী চুপ করে থাকবে? কোনও এক সময় নিজেই নেমে পড়ে অতি উৎসাহে। তারপর মর্মান্তিক পরিণতি। চিকিৎসকরা বলছেন, অনেকক্ষেত্রে বাবা মা জানতেই পারেননা ছেলে বা মেয়ের হার্টে ফুটো থাকার কথা। যখন জানতে পারেন তখন সব শেষ। কিন্তু আনন্দের কথা এরকমই প্রায় ১৬৫০ জন পড়ুয়ার হার্টের ফুটো চিহ্নিত করায় জীবন রক্ষা পেয়েছে তাঁদের এবং এই অনুসন্ধানটি সম্ভব হয়েছে আয়ুশ (Ayush Doctor) চিকিৎসকদের জন্য।
কী এই হার্টের অসুখ? চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ বা CHD (Congenital Heart Disesase) বাংলায় জন্মগত হার্টের অসুখ। হৃদযন্ত্রের নিলয় বা অলিন্দে কিংবা দুটি জায়গাতেই ফুটো নিয়ে জন্মানো শিশু। অত্যধিক হাঁফাতে শুরু করলে দম নিলেও দম ধরে রাখা যায়, ফুটো বেলুনের মত বাতাস বেরিয়ে যায়। সময়মত ধরা পড়লে এবং চিকিৎসা হলে মোটামুটি খরচ ১০লক্ষ টাকা। পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতে প্রতি ১০০জন শিশুর সর্বাধিক ৬জন এই রোগ নিয়ে জন্মান। সারা দেশজুড়ে এই শিশুদের চিহ্নিত করার কাজ করছেন আয়ুশ চিকিৎসকরা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প RBSK বা ‘রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রম’ এর অধীনে আয়ুশ চিকিৎসকরা সারা বছর কাজ করে যাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্পটি শিশুসাথী প্রকল্প নামে চলায় অনেকেই মূল প্রকল্পটি জানতে পারেননা। এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্যই হল নিখরচায় শিশুদের হার্ট সার্জারির মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া।
যদিও শুধু হার্ট অপারেশন নয় আয়ুশ চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, এই প্রকল্পের আওতায় ০-১৮ বছর বয়স অবধি শিশু-কিশোর বয়সীদের মোট ৪৭টি রোগের ওপর নজরদারি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকেন। যারমধ্যে রয়েছে জন্মগত ছানি, জন্মগত বধিরতা, জন্মগত হৃদরোগ, দাঁতের অবস্থা, খিঁচুনি রোগ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা, নিউরো- মোটর বৈকল্য ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভাবে তাঁরা নজরদারিতে রাখেন মাসিকের সমস্যা, বিলম্বিত মাসিক, অনিয়মিত মাসিক, যেকোনো স্রাবের দুর্গন্ধ, সাদাস্রাবের সমস্যা,পেচ্ছাপ করার সময় জ্বালা, মাসিকের সময় পেটে যন্ত্রণা ইত্যাদি ইত্যাদি। মূল উদ্দেশ্য জন্মগত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে শৈশবকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা।
কীভাবে কাজ করেন আয়ুশ ডাক্তারবাবুরা? ডাক্তারবাবুরা তাদের নির্দিষ্ট রুটিন অনুযায়ী বছরে একবার করে প্রতিটি বিদ্যালয়, প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয় এবং বছরে দুবার অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারগুলি আছে সেখানে গিয়ে প্রত্যেকটি বাচ্চার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেন। এই ডাক্তার বাবুরা যখন বাচ্চার হার্টের প্রবলেম ডিটেক্ট করেন তখন তারা সেই বাচ্চাটিকে কাছাকাছি কোন হাসপাতালে যেমন মহকুমা কিংবা জেলা হাসপাতালে পাঠান। সেখান থেকে তারা বাচ্চাটিকে ইকোকার্ডিওগ্রাফি করার পরামর্শ দেন l ওখান থেকে ইকোকার্ডিওগ্রাফি করার পরে যখন তাতে প্রবলেম ধরা পড়ে সেই রিপোর্ট নিয়ে আবার এই আয়ুশ মেডিকেল অফিসারের কাছে এসে দেখা করে। মেডিকেল অফিসাররা তখন বাচ্চাটির সমস্যার জন্য যে রিপোর্টগুলো করিয়েছে অর্থাৎ ইকোকার্ডিওগ্রাফির সেই রিপোর্ট, RBSK রেফারাল কার্ড, বাচ্চার বাবা বা মায়ের আধার কার্ড বা যে কোন পরিচয় পত্র, বাচ্চার জন্ম সার্টিফিকেট, বাচ্চার বাবা মা এর ফোন নাম্বার, এবং বাচ্চা দু কপি ফটো সমেত জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের শিশুসাথী বিভাগে পাঠান। সেইখান থেকে অনুমোদন আসার পর শিশুটির চিকিৎসা হয় শুরু হয়।
এই পদ্ধতিতেই ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষে সরকারী হাসপাতালে ২০৪জন এবং বেসরকারি হাসপাতালে ১৪১৯জন শিশুর হার্টের অপারেশন হয়েছে। নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে তারা। শুধু তাই এছাড়াও ৩০৬টি শিশুর জন্মগত বাঁকা পা সারানো হয়েছে, ৪০৭টি শিশু যাদের ঠোঁট কিংবা তালু কাটা ছিল তাদের সেসব ঠিক করা হয়েছে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে আয়ুশ চিকিৎসকদের উদ্যোগের ফলেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই রাজ্যে আয়ুশ চিকিৎসকরা তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা বা সাম্মানিক কোনওটাই পাননা। অনেকে জানেনই আয়ুশ চিকিৎসকদের কথা। রাজ্যের ২টি বৃহৎ আয়ুশ হাসপাতাল কার্যত: অবহেলায় পড়ে রয়েছে। কেন? সে কথা বরং অন্যদিন বলা যাবে।