নরেশ জানা: ” নমস্কার। আমার নাম অনির্বাণ। আমি বাংলা থিয়েটারে ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করি। ইদানীং পরিচালনার কাজও করেছি। আমি আজ বেলেঘাটাতেই শুটিং করছি, কিন্তু খুবই টাইট শিডিউল থাকায় সভাতে উপস্থিত থাকতে পারছি না। কিন্তু আমি এই সভায় উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলাম, কারণ গায়ে হাত উঠেছে। নিশ্চয়ই আগেও উঠেছে, অভিনেতার গায়ে, নাট্যকর্মীর গায়ে। সুদূর বা অদূর ইতিহাসে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমার জানার মধ্যে এই প্রথম হাত উঠেছে। আমি প্রতিবাদ করছি, আরো অনেকের সঙ্গে, এটা জেনেই, যে এই প্রতিবাদ ব্যর্থ হবে। যার গায়ে হাত উঠেছে, তার গায়ে আবার হাত উঠতে পারে শীঘ্রই, এবং যিনি হাত তুলেছে, তিনি তার সাহসে বলীয়ান হয়ে বাংলা মায়ের সুযোগ্য সন্তানের অনেকগুলো সার্টিফিকেট ঘরে বাঁধিয়ে রাখবেন।” মাত্র কয়েক দিন আগেই কলকাতার বুকে তৃনমূল নেতা কর্মীদের হাতে বেধড়ক মার খাওয়া সতীর্থ নাট্যকর্মী অমিত সাহার পাশে এভাবেই দাঁড়ালেন মেদিনীপুর শহরের সন্তান সর্বজন প্রিয় অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য।
২৩ তারিখ পূর্ব কলকাতা বিদুষক নাট্যমণ্ডলীর সভাপতি অমিত সাহা ও সম্পাদক অরূপ খাঁড়া মার খাওয়ার পরই বন্ধ করে দেওয়া হয় তাঁদের ২ দিনের নাট্যোৎসব। পরিবর্তে ২৮ তারিখ ফুলবাগান মোড়ে তাঁরা পথ সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে সমস্ত নাট্য দলকেই আহ্বান জানানো হয়। আমন্ত্রিত হন অনির্বানও। কিন্তু নিজের নাটকের শো থাকায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। পরিবর্তে একটি চিঠি পাঠান তিনি। যা পড়ে শোনানো হয় ওই সভায়। আগুন ঝরানো সেই চিঠির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে তীব্র শ্লেষ আর ভর্ৎসনা। নিজের পরবর্তী নাটকের শোয়ের স্থান এবং সময় জানিয়ে শাসকদলের লোকেদের প্রতি তাঁর আহ্বান, আসুন আমাকেও মেরে যান।
তিনি বলেছেন, ” কে জানে হয়তো কালের অদ্ভুত নিয়মে একদিন বাংলার সংস্কৃতি মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন, দল বদলালে হয়তো ভারতেরও। এটা বা এরকম কিছুই হয়তো হবে। আমি এই ঘটনাকে বুঝে নিতে চাইছি রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে।আজ থেকে ১২ দিন আগে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে অমিতাভ বচ্চন বাকস্বাধীনতার সপক্ষে বক্তৃতা করে গেছেন। শাহরুখ খান সোশ্যাল মিডিয়ার ঘৃণাবাহিনীকে এক হাত নিয়েছেন, সারা ভারতে মুক্তমনা মানুষ হাততালি দিয়ে উঠেছেন। সেদিন যারা মঞ্চে ছিলেন, তারাও দিয়েছেন।” অনির্বাণ বলেন, ” তার কিছুদিন পরেই অমিত সাহা ও অরূপ খাঁড়া মার খেয়ে গেলেন, নাট্য উৎসব আয়োজন করার জন্য। একই রাজ্যে! কেন? কারণ অমিত সাহা ও অরূপ খাঁড়া পশ্চিমবঙ্গের বোধ করি একটি ভোটকেও ডিস্টার্ব বা পেট্রনাইজ করতে পারেন না। অমিতাভ বচ্চন বা শাহরুখ খান পারেন। তাই, চলুন, আমরা নাটক ছেড়ে একটা মার খাওয়ার উৎসবের দিকে এগিয়ে যাই।”
রাজ্যে উৎসবের রাজনীতিকে এভাবেই কটাক্ষ করার পাশাপাশি বাংলার এই সময়ের বলিষ্ঠ অভিনেতা আরও বলেন, ” আমরা রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াই। প্রতিটি অঞ্চলের পার্টি অফিসে আমরা আবেদন পত্র জমা দিই আমাদের নাটক অভিনয়ের দিন ও স্থান সমেত, আমাদের যেন এসে বেদম মার দেওয়া হয়, যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয় হাড়ে হাড়ে যে ভোটকেন্দ্রিক গণতন্ত্রে অমিতাভ বচ্চন বা শাহরুখ খান না হলে বেশি লাফাতে নেই।
সারা ভারতবর্ষের সিনেমা ও থিয়েটার অভিনেতারা যেন জানতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গে এক অভূতপূর্ব আনন্দযজ্ঞ শুরু হয়েছে, ভোট রাজনীতিতে কাজে আসে না, এমন শিল্পীদের মেরে ঠান্ডা করে দেওয়া হচ্ছে। এই শিক্ষা সারা দেশ আমাদের রাজ্য থেকেই পাক।”
হয়ত এত ঘটনার পরও নিশ্চুপ থাকা কার্যত বাংলার কতিপয় বুদ্ধিজীবীর দিকে নজর রেখেই তাঁর আহ্বান, ” চলুন , অভিনয় চর্চা, গানবাজনা ছেড়ে আমরা আগে আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বটা বুঝে নিই আমাদের আজকের বাস্তবতায়। আবেদন পত্র জমা দেওয়া শুরু হোক।অখ্যাত, বিখ্যাত, নামী, অনামী সমস্ত অভিনেতারা চলুন এক যোগে মার খাওয়ার আবেদন জানাই। আমি অনির্বাণ। আমার এর পরের অভিনয় ১৫ই জানুয়ারি রবীন্দ্র সদন মঞ্চে। এসে মেরে যান। কারণ এই দিন এর অভিনয়ে ভোট রাজনীতির কোনো মুনাফা নেই, এমন ফালতু ঘটনা রাজ্যে প্লিজ একটাও ঘটতে দেবেন না, অনুরোধ। সবশেষে কেক উৎসবের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি। অনির্বাণ।” উল্লেখ্য বেলেঘাটা রাসমেলা মাঠে ২৪ এবং ২৫ ডিসেম্বর ওই নাট্যোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল কিন্তু ওই মাঠে যেহেতু ২৪ তারিখ তৃনমূল নেতার কেক উৎসবের আয়োজন করা যাবেনা এই কারনেই ওই দুই নাট্যকর্মীকে মাটিতে ফেলে পেটানো হয়।