নিজস্ব সংবাদদাতা: নতুন বছরের মাস পয়লা দুঃসংবাদ এসেছিল কলকাতা পুরসভার অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের জন্য। কলকাতা কর্পোরেশন নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর অবসর নেওয়া কর্মীদের পেনশন বন্ধ করা হচ্ছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। আর ২০২২ আর্থিক বছর শুরুর মুখে দুঃসংবাদ এল শিক্ষকদের জন্য! রাজ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পেনশন, গ্র্যাচুইটি সহ অবসরকালীন সমস্ত আর্থিক সুবিধা। জানা গেছে গত ছয় মাস ধরে রাজ্যে অবসর নেওয়া কোনও শিক্ষক পাচ্ছেন না আর্থিক সুবিধা। রাজ্যে প্রায় ৬ হাজার শিক্ষক এখন অবসর নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন পেনশনের। নজিরবিহীন আর্থিক সঙ্কটের মুখে আরও প্রায় ১ হাজারের উপর সরকারি কোষাগার থেকে বেতন নিয়ে অবসর নেওয়া কর্মী।
নিদারুণ অর্থ সঙ্কটের মধ্যেও যখন রাজ্যে বহাল তবিয়তে চলছে দান খয়রাতির পালা। ক্লাবে টাকা, দুর্গাপূজায় টাকা, খেলায় মেলায় টাকা উড়ছে দেদার। তখন কবে ফের পেনশন চালু হবে? কবে পাওয়া যাবে গ্র্যাচুইটির টাকা? তার সদুত্তর দিতে পারছে না রাজ্যের অর্থ দপ্তরের অধীন সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এক অবসর নেওয়া শিক্ষকের বক্তব্য,‘‘গত শনিবারও পেনশন অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম। আধিকারিকের বক্তব্য ছিল, দেরি হবে। কবে হবে কোনও ঠিক নেই!’’ সল্টলেকের পূর্ত ভবনের দোতলায় ডিপিপিজি (ডিরেক্টর অব পেনশন পিএফ অ্যান্ড গ্রুপ ইনসিওরেন্স)-র অফিস। কাজের দিনে এখন ওই অফিসে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের। ছয় মাস আগে অবসর নিয়েছেন। সব কাগজপত্র তৈরি করে ডিআই অফিসের অনুমোদন নিয়ে পাঠানো হয়েছে ডিপিপিজি অফিসে। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে। কেন পেনশন চালু হচ্ছে না, তা জানার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে শিক্ষকদের।
উল্লেখ্য রাজ্যের সরকার পোষিত স্কুলের শিক্ষক, রাজ্যের পৌরসভা, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের কর্মচারী, খাদি বোর্ড, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ, কলেজ সার্ভিস কমিশন, এইচআরবিসি, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, ওয়াকফ বোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষা, এনআইএএস, সোশাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড সহ প্রায় ৩৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পেনশনের দায়িত্ব পালন করে ডিপিপিজি। রাজ্যের অর্থ দপ্তরের অধীন সেই ডিপিপিজি’তেই গত ৬ মাস ধরে বন্ধ হয়ে আছে প্রায় ৭ হাজারের ওপর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, কর্মচারীদের অবসরকালীন আর্থিক সুবিধা। উদাহরন তুলে ধরে রাজ্যের একটি বাংলা দৈনিক জানিয়েছে, গত ৩১ ডিসেম্বর প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন বেহালার শিক্ষক শঙ্খনাথ মুখার্জি। তাঁর কথা,‘‘মার্চ পড়ে গেল। এখনও পেনশন চালু হয়নি। গ্রাচুইটি কবে পাব কোনও ঠিক নেই। ২৫জানুয়ারি ফাইলটি যে টেবিলে ছিল, মার্চ মাসেও সেই একই টেবিলে পড়ে আছে। কবে পেনশন পাব, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আধিকারিকরাও বলতে পারছেন না, কবে পেনশন চালু হবে!’’
ওই দৈনিকের বক্তব্য, ডিপিপিজি সূত্রে জানা গিয়েছে, এক একজন আধিকারিকের ‘লগ ইন’এ প্রায় ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ করে পেনশন ফাইল পড়ে আছে। নবান্নের অর্থ দপ্তরের নির্দেশে সেই ফাইল ছাড়া হচ্ছে না। কারণ, পেনশন ফাইল প্রস্তুত করে ছাড়ার পর ট্রেজারিতে ও পেনশন গ্রাহকদের কাছে পিপিও পাঠাতে হবে। আর তা পাওয়ামাত্রই চালু করতেই হবে পেনশন। কিন্তু আটকে রাখা হচ্ছে পেনশন ফাইল। পূর্ত ভবনে পেনশন অফিসে খোঁজ নিতে আসা শিক্ষকদের নানা অজুহাত দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ২০১৬ সালের পে কমিশনের ভিত্তিতে নয়া বেতন কাঠামোতে একজন শিক্ষক অবসর নেওয়ার পর ২৭ লক্ষ টাকা তাঁর অবসরকালীন আর্থিক প্রাপ্য হবে। প্রধান শিক্ষকের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৩০ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। ফলে সবার পেনশন ছেড়ে দিলে এই মুহূর্তে ২০০ কোটি টাকার ওপর খরচ হবে রাজ্যের। সেই টাকাও সরকার খরচ করতে এই মুহূর্তে রাজি নয়।
ওই পত্রিকাটির মতে এর কারণ, মুখ্যমন্ত্রী ইদানীং সরকারি সব বৈঠকেই উল্লেখ করে থাকেন। ‘‘যেহেতু আয় কম হচ্ছে, তাই কতগুলি জিনিস আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে চলা উচিত। কোনও অপ্রয়োজনীয় বাজেট বহির্ভূত খরচ যেন না হয়। বাজেটে থাকলেও খরচ না করে সরকারের টাকা বাঁচানো যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’’ গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাজ্য প্রশাসনের পর্যালোচনা বৈঠকে জানিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ওই বৈঠকেই শুধু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প চালাতে সরকারের তিন মাসে ৪ হাজার কোটি টাকার ওপর খরচের হিসাব দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। শিক্ষক সহ সরকারি কর্মীদের চাকরি থেকে অবসরের পর পেনশন সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সামাজিক প্রকল্প। সেই প্রকল্পেই কোপ সরকারের।