শশাঙ্ক প্রধান : ৩০টি পরিবারে ১১০ জন। আধারকার্ড নেই, রেশনকার্ড নেই, ওদের দুয়ারে নেই সরকার। স্বাস্থ্যসাথী কিংবা লক্ষীভান্ডারের নামই শোনেননি এঁরা। ১১০জনের মধ্যে ১জনকে খুঁজে পাওয়া গেল যিনি প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি পার হয়েছেন। অথচ গ্রাম থেকে ৮০০ মিটারের মধ্যেই প্রাথমিক স্কুল। গ্রামের ঢোকার রাস্তা কাঁচামাটির, বিদ্যুতের খুঁটি ঘোষণা করেছে সভ্যতার কিন্তু তারে বিদ্যুৎ আসেনি কোনও দিন। এত কিছু না থাকলেও আছে মূল্যবান একটা জিনিস, তাহ’ল ভোটার কার্ড। ঘরে ঘরে ওই জিনিসটি আছে কারন ওঁদের ভোট যে খুবই দামী। সেই কার্ড বলে দেয় গ্রামের মানুষগুলো এদেশের নাগরিক আর এই রাজ্যের বাসিন্দা। বাদ বাকি সব কিছুতেই এরা আসলে নেই রাজ্যের বাসিন্দা।
পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং থানার অন্তর্গত দাঁররা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত খোলাগেড়্যা মৌজার সাকিন বাগালপাড়া। চাঁদকুড়ি থেকে পটাশপুরগামী রাজ্য সড়কের মাসন্তপুকুর থেকে যে রাস্তা ডান হাতে নারায়নগড় থানার দিকে চলে গেছে সেই রাস্তায় কিছুটা গিয়ে খোলাগেড়্যা গ্রামের ভেতর ঢুকে ডানদিকে চলে যাওয়া একটি ঢালাই রাস্তা হঠাৎ করে শেষ হয়ে যেন সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করেছে। শুরু হয়েছে সেই প্রাক স্বাধীনতা আমলের মাটির কাঁচা রাস্তা। তখনই বুঝতে হবে শুরু হয়েছে ‘নেই রাজ্যে’র দেশ, বাগালপাড়া। কিছু নেইয়ের রাজ্যে ভোটার কার্ড ছাড়া আরও একটি জিনিস মেলে। তার নাম চুল্লু বা চোলাই। স্থানীয়রা কেউ কেউ পচাই বলেও ডাকে।
অফুরন্ত মদের জোগানে শৈশব সেখানে নেশায় ডুবে । নাবালক অবস্থাতেই বিয়ে, সন্তান ধারণ এখানকার চিরাচরিত রীতি নীতি। রয়েছে তুমুল অভাব এবং বঞ্চনা। অশিক্ষার গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত এখানকার প্রায় সকলেই। বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা আর দিনমজুরিই উপার্জনের একমাত্র উপায় হলেও রোজগারের সিংহভাগই চলে যায় নেশার পেছনে। সারা পাড়াতেই নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। এর পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় লোকজনদের বিরুদ্ধে শ্রমশোষণের মতো গুরুতর অভিযোগও। গোটা গ্রাম খুঁজলে ১২বছরের ওপরে চারটি মেয়ে পাওয়া যায় কারন বাল্যবিবাহের দস্তুর এখানে রীতিমত। ৩০বছরেই বার্ধক্য নেমে আসে এই গ্রামে।
এমনই এক গ্রামে একটি আস্ত পাঠশালা পৌঁছে দিলেন পেশায় শিক্ষক দুই বন্ধু। স্কুলবিমুখ বাগালপাড়ার দুয়ারে পাঠশালা নিয়ে হাজির হলেন সবংয়ের চাঁদকুড়ির বাসিন্দা শান্তনু অধিকারী ও পূর্ব মেদিনীপুরের হাউরের বাসিন্দা ভাস্করব্রত পতি। বুধবার এই দুই বন্ধুর ব্যবস্থাপনায় ২৮ জন পড়ুয়া নিয়ে ‘বর্ণপরিচয়’ নামে এই পাঠশালাটির সূচনা ঘটল আজ। উদ্দেশ্য, এখানকার শৈশবকে স্কুলমুখী করে তোলা। এবং অক্ষরজ্ঞানহীন বড়দেরও স্বাক্ষর করে সামাজিক চেতনার বিকাশ ঘটানো। এদিন, হাতে খাতা, কলম, বই তুলে নিয়ে দেবীর আরাধনাও করল এখানকার শিশুরা। তবে কোনও প্রথাগত মন্ত্রোচ্চারণে নয়। দেবী দুর্গার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মাটির ঘটে জলসিঞ্চন করে শপথবাক্য পাঠের মাধ্যমে।
উদ্যোক্তাদের অন্যতম, পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা ভাস্করব্রত পতি জানান― শিক্ষাই পারে এখানকার বাসিন্দাদের প্রকৃত উন্নয়নের সরণীতে নিয়ে যেতে। নিজেদের অধিকারবোধ সম্পর্কে সচেতন করতে। মুষ্টিমেয় ত্রাণ কখনও সমস্যার সমাধান করতে পারে না। পরিত্রাণের পথ খোঁজাই আসল। তাই এই উদ্যোগ। তিনি জানান, এই পাঠশালা আপাতত সপ্তাহে চারদিন চলবে। জোর দেওয়া হবে খেলাচ্ছলে পড়াশোনায়। রয়েছে পুজোর পরে এখানকার শিশুদের নিয়ে একটি শিক্ষামূলক ভ্রমণের পরিকল্পনাও।
প্রসঙ্গত শিক্ষক শান্তনু অধিকারী বিগত কয়েক বছর ধরেই এখানকার বাসিন্দাদের নিয়ে কাজ করে আসছেন। তিনি বলেন― এই বাগালরা আসলে খেড়িয়া শবর। এঁদের প্রকৃত পদবি বাগাল নয়, দেহরি। স্বভাবগত কারণেই এঁরা ভীতু ও মুখচোরা। সভ্যতাবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে ভালোবাসেন। ভোটার লিস্টে নাম তোলার সময়ই ঘটে গেছে পদবি বিভ্রাট। যে কারণে আজও তাঁদের মেলেনি তপশিলি উপজাতির স্বীকৃতি। ফলে এঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন নানা ধরনের সরকারি সুবিধা থেকেও। তিনি আরও বলেন, ‘কেবল পাঠশালা নয়। আগামীদিনে এঁদের নানা ধরনের সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দিতে প্রশাসনিক স্তরেও কাজ করবে বর্ণপরিচয়’।
এদিন বর্ণপরিচয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় এই পাড়ারই আশি ঊর্ধ্ব দেবেন বাগালের হাত ধরে। তাঁর হাত দিয়েই লাগানো হয় স্মারকস্বরূপ একটি ফলের চারা। এদিন পড়ুয়াদের দেওয়া হয় নতুন পোশাক। সেই সঙ্গে যাবতীয় শিক্ষা ও অংকন সামগ্রী। দেওয়া হয় খেলধুলার সরঞ্জামও। এদিন এই উদ্বোধন উপলক্ষে পাড়ার সকলের জন্য প্রীতিভোজেরও ব্যবস্থা করেন দুই শিক্ষক। এঁরা ছাড়াও এদিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত মনোরঞ্জন রায়, কমল রায়, নিখিল কুইল্যা এবং বর্ণপরিচয়ের শিক্ষিকা প্রিয়াংকা ভূঞ্যা প্রমুখ। বর্ণপরিচয়ের জন্ম হল বাগালপাড়ায়। বর্ণপরিচয়ের হাত ধরে বাগালপাড়ার পুনর্জন্ম হয় কিনা, এখন সেটাই দেখার!