নিজস্ব সংবাদদাতা: মেঘ ভাঙা বৃষ্টির সাথে ব্যাপক ভূমিধস নামায় উত্তরাখণ্ডে এখনও অবধি অন্ততঃ ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ৫জনের নিখোঁজ থাকার খবর পাওয়া গেছে। হ্রদের শহর নৈনিতাল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে উত্তরাখণ্ডের বাকি অংশ থেকে। কালাধুঙ্গি, হলদোয়ানি, ভাওয়ালি যাওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জানা গেছে এই ৩৪জনের বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয়েছে নৈনিতাল জেলায়। সোমবার ৬জনের মৃত্যুর খবর এসেছিল পাউরি এবং চম্পাওয়াত জেলা থেকে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নৈনিতালের অবস্থা তখনও বোঝা যায়নি। মঙ্গলবার একের পর এক মৃত্যুর খবর এসেছে সেখান থেকেই। এখনো আটক রয়েছেন প্রায় ১৫০০পর্যটক। আটক থাকা পর্যটকদের মধ্যে বেশ কিছু বাঙালি পর্যটকও রয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বাঙালি পর্যটকের মধ্যে হাওড়া ও হুগলির একাধিক ব্যক্তি বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেননা তাঁদের পরিবার ফলে উৎকন্ঠা বাড়ছে।
উত্তরাখন্ড সরকারের তথ্য অনুযায়ী এখনও অবধি ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে যাঁরা নেপাল, উত্তরপ্রদেশ ও স্থানীয় চম্পাওয়াত ও নৈনিতাল জেলার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। ব্যাপক ভূমিধসের ফলে রুদ্রপ্রয়াগের সঙ্গে সংযুক্ত তিনটি জাতীয় সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
উত্তরাখন্ড সরকার সূত্রে জানা গেছে রাজ্যের পাউরি জেলার একটি নির্মিয়মান হোটেল ভূমিধসের কারনে গুঁড়িয়ে যাওয়ায় দুই নেপালের দম্পত্তি ও তাঁদের চার বছরের কন্যার মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে রুদ্রপ্ৰয়াগে ২৭ বছরের এক যুবক পাথরের চাঁইয়ের আঘাতে মৃত্যু বরন করেছেন। ইনি কানপুরের বাসিন্দা। চম্পাওয়াতে কাদার তালের নিচে বাড়ি কবরস্থ হয়েয়ে মৃত্যু হয়েছে এক ৪৮বছরের মহিলা ও তাঁর ১৭বছরের পুত্রের। জানা গেছে নৈনিতালের রাস্তায় আটকে রয়েছেন বহু পর্যটক। সোমবার থেকেই গাড়োয়াল ও কুমায়ুনের গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী জাতীয় সড়ক এবং তার বিভিন্ন উপসড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে প্রবল ভূমিধসে।
আগামী ৪৮ ঘন্টা আরও ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার পূর্বাভাস থাকায় চারধাম যাত্রা আপাততঃ স্থগিত রাখা হয়েছে। চম্পাওয়াতের পূর্নগিরি মন্দির দর্শনার্থী ২০০জনকে প্রশাসন উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেছে। আগামী ২/৩দিন পূর্নগিরি দর্শন করতে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে পুণ্যার্থীদের। রুদ্রপ্ৰয়াগের জেলা শাসক মনুজ গয়াল উত্তরাখণ্ডের মূখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, রবিবার কেদারনাথে ৬০০০ পর্যটক ও পুণ্যার্থী ছিলেন যারমধ্যে ৪০০০ফিরে গেছেন। বাকী ২০০০জনকে জেলা প্রশাসন নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
এদিকে পুজোর ছুটিতে হাওড়া, হুগলি, কলকাতা থেকে উত্তরাখণ্ডে বেড়াতে গিয়ে আটকে পড়েছ জানা গিয়েছে, পুজোর ছুটিতে হাওড়া, হুগলি, কলকাতা থেকে উত্তরাখণ্ডে বেড়াতে গিয়ে আটকে পড়েছেন ১৪ জন বাঙালি পর্যটক। তাঁরা গত ১২ অক্টোবর, সপ্তমীর রাতে ট্রেন ধরেছিলেন। সোমবার রাতে অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর তাঁদের হাওড়ার ট্রেন ধরার কথা ছিল। কিন্তু সোমবার রাতেই মেঘভাঙা বৃষ্টিতে ধস নেমে বিপর্যস্ত অবস্থা নৈনিতাল সহ উত্তরাখণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকার। ফলে মাঝ পথেই আটকে পড়েছেন ওই ১৪ জন বাঙালি পর্যটক। যার মধ্যেই অধিকাংশই হাওড়ার কোনার বাসিন্দা। ফলে চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে তাঁদের আত্মীয়-পরিজনদের।
উত্তরাখণ্ডে ধসে আটকে পড়া বাঙালিদের মধ্যে হাওড়ার কোনার বাসিন্দা মলি কাঁড়ারের স্বামীও রয়েছেন। স্বামীর চিন্তায় উদ্বিগ্ন মলিদেবী বলেন, ‘গতকাল রাত ১২টা নাগাদ ফোন করে জানায় ওঁরা ধসে আটকে পড়েছে। ট্রেন ধরতে পারবে না। তারপর আজ সকাল থেকে ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়নি। খুব চিন্তা হচ্ছে’ মলি কাঁড়ারের স্বামীর সঙ্গে এই ট্যুরে তাঁদের প্রতিবেশী বাসন্তী মান্নার ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতিও গিয়েছে। তাঁদের চিন্তায় উদ্বিগ্ন বাসন্তী দেবী এখন ঈশ্বরের উপরই ভরসা করছেন।’
মলিদেবী, বাসন্তীদেবীরা জানান, ১৪ জনের ওই গ্রুপটি প্রথমে নৈনিতাল যায়। তারপর আলমোরা, রানিখেত হয়ে কাঠগুদাম থেকে ফেরার ট্রেন ধরার কথা ছিল। সেইমতো সোমবার তাঁরা গাড়ি করে রানিখেত থেকে কাঠগোদামের দিকে যাচ্ছিলেন। তখনই কাচছি ধাম এলাকায় পাহাড়ি ধসের কবলে পড়েন বলে জানিয়েছেন আটকে পড়া যাত্রীরা। ধসের পাশাপাশি প্রবল ঝোড়ো হাওয়া এবং মেঘভাঙা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পড়েন তাঁরা। মাঝপথে গাড়িতেই আটকে পড়েন। অবশেষে গ্রামবাসীদের সহায়তায় একজনের বাড়িতে রাতে আশ্রয় মেলে বলে ফোনে জানিয়েছেন মলিদেবীর স্বামী। কিন্তু এদিন সকাল থেকে আর তিনি ফোন করেননি। বাসন্তীদেবীও ছেলে, পুত্রবধূর ফোন পাননি। কোনার আরেক বাসিন্দা উজ্জ্বল জানিয়েছেন , ‘আমার দাদা-বৌদিও ওই গ্রুপে আছে। তাঁদের ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায়, কীভাবে আছে, আদৌ উদ্ধার হয়েছে কিনা জানি না।’
অন্যদিকে হুগলির চুঁচুড়া পুরসভার ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা চুমকি রায়ের পরিবার বেড়াতে গিয়েছিল কেদারনাথ। প্রবল বৃষ্টিতে সেখানেই তারা আটকে পড়েছেন। দুদিন ধরে খাবার, জল না পেয়ে প্রবল সমস্যায় পড়ছেন তাঁরা। প্রশাসনের কোনও সাহায্যেই তাঁরা পাচ্ছেন না বলে দাবি চুমকি রায়ের পরিবারের। গত ১৫ অক্টোবর রওনা হয়ে ১৭ অক্টোবর কেদারনাথে পৌঁছন চুমকি রায় ও তাঁর স্বামী বিশ্বজিৎ রায় ও তাদের মেয়ে অন্বেষা। তাদের সঙ্গে রয়েছেন আরও দুজন-অরিজিত্ শীল ও সত্যব্রত মুখোপাধ্য়ায়। ভারী বৃষ্টি শুরু হতেই শুরু হয় ধস। অরিজিৎ ও সত্যব্রতবাবু ঝুঁকি নিয়ে গৌরীকুণ্ডে নেমে আসতে পারলেও চুমকিরা নামতে পারেননি।
এদিকে, ভারী বৃষ্টির সঙ্গে চলছে ঝড়। ফলে উদ্ধারকাজ প্রবল বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কেদারনাথে যে কপ্টার সার্ভিস ছিল তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কেদারনাথে আটকে রয়েছেন প্রায় দেড় হাজার পর্যটক। এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে সকলের একটাই প্রার্থনা, রাজ্য সরকার কিছু ব্যবস্থা নিক, যাতে ঘরের লোকেরা সুস্থভাবে ঘরে ফিরে আসেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে উত্তরাখণ্ডের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। শেষ খবর পাওয়া অবধি উদ্ধারকার্যে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বায়ুসেনা যুক্ত হয়েছে।