Saturday, July 27, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১২৭।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

রঘুনাথ মন্দির, ধামতোড় (ডেবরা)                             খৃষ্টিয় একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ওডিশার রাজা ছিলেন অনঙ্গ বর্মা চোড়গঙ্গদেব। বাংলার সীমান্তে অবস্থিত মেদিনীপুর জেলার প্রায় সমগ্র এলাকা তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলায় মুসলমান বিজয়ের গোড়ার দিকে, উৎকলরাজ ছিলেন অনঙ্গ ভীমদেব। রাজ্যের সীমানা আরও বিস্তার ঘটেছিল তাঁর সময়ে। ষোড়শ শতাব্দীর প্রায় মঝামাঝি, অর্থাৎ কলিঙ্গরাজ হরিচন্দন মুকুন্দদেবের মৃত্যু পর্যন্ত, এই অবস্থা বহাল ছিল। এক কথায়, বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে যখন সুলতানি শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত, মেদিনীপুর জেলায় তখনও প্রচলিত ছিল ওডিশার হিন্দু রাজাদের শাসন।

অঙ্কের হিসাবে এই দীর্ঘ সাড়ে চারশ’ বছর, বড় কম সময় নয়। এই সময়কালে, ওডিশা ও বাংলার বহু মানুষ বিভিন্ন উপলক্ষে এদিক থেকে ওদিকে যাতায়াত করেছেন। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ, পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় অনেকগুলি জমিদার বংশ আছে , যারা কোন না কোনও সময়ে, ওডিশা থেকে বাংলায় চলে এসেছিলেন। এবারের এই জার্ণালে, তেমনই একটি পরিবার এবং তাঁদের মন্দিরের সালতামামি।

ওডিশার জাজপুর এলাকার নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ জনৈক নবীন চন্দ্র পতি মূলত ভাগ্যসন্ধানে পৈতৃক ভিটে ছেড়ে বাংলায় চলে এসেছিলেন। সেকালের প্রসিদ্ধ জগন্নাথ সড়ক ধরে উত্তরমুখে রেমুনা ছাড়িয়ে সুবর্ণরেখা পার হয়েছিলেন। কটক রাস্তা ধরে এগিয়ে, থেমেছিলেন সাহাপুর পরগণার আজকের ধামতোড় গ্রামে।

নতুন এলাকায় ভাগ্যদেবীর কৃপাদৃষ্টি পড়েছিল পতিবংশের উপর। ধীরেধীরে সম্পদশালী হয়ে, নিজেদের একটি জমিদারীও গড়েছিল এই বংশ। তাঁদের মহাল ছিল ধামতোড়, দলপতিপুর, নছিপুর, বেনিয়া ইত্যাদি মৌজায়।

জগন্নাথভূমি ওডিশা থেকে বাংলায় এসেছিলেন পতিরা। মেদিনীপুর জেলা জুড়ে তখন চৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রবল স্রোত প্রবহমান। বৈষ্ণব ধর্মগুরু শ্যামানন্দ প্রভুর ধর্মপ্রচারে ঘরে ঘরে ভগবান বিষ্ণু কিংবা রাধাকৃষ্ণের আরাধনা প্রচলিত হয়েছে।

সেই স্রোতে অবগাহন করেছিলেন পতিবংশও। বিষ্ণুকেই ইষ্টদেবতা জ্ঞান করেছিলেন। রঘুনাথ নামিত একটি শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠা করে সেবাপূজার প্রচলন করা হয়েছিল।  ধামতোড়ে পতিবংশের প্রতিষ্ঠাতা নবীন চন্দ্রের জেষ্ঠ্য পুত্র রামদয়াল। রামদয়ালের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন প্যারীলাল পতি। প্যারীলাল তাঁর পিতা রামদয়াল পতি-র স্মৃতিতে, রঘুনাথের জন্য নিজেদের বাস্তুর ভিতর একটি স্থায়ী মন্দির গড়ে দিয়েছিলেন।

নিজস্ব সম্পত্তি আছে দেবতা রঘুনাথের। নিত্যপূজা ছাড়াও, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, রাস উৎসব, মকর, চাঁচর-দোল পূর্ণিমা ইত্যাদি সম্বৎসরের সমস্ত পার্বণ আয়োজিত হয় সেই সম্পত্তির উপস্বত্ত্ব থেকে।

সম্পূর্ণ বর্গাকার পূর্বমুখী ইটের মন্দিরটি দালান-রীতিতে নির্মিত হয়েছে। দুটি অংশ মন্দিরের—সামনে একটি অলিন্দ, পিছনে গর্ভগৃহ। অলিন্দে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ। সরলরেখায় নকশাকাটা গোলাকার স্তম্ভ, আর খিলানগুলি দরুণ-রীতির। মন্দিরের মাথার ছাউনি অংশটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। বর্তমানে টিনের ছাউনি দেওয়া। তবে, সেবাইত বংশ থেকে জানা যায়, অলিন্দ এবং গর্ভগৃহ—দুইয়ের মাথাতেই টানা-খিলানের ছাউনি ছিল।

সামনের দেওয়ালের মাথায় আলসের কিছু অংশ এখনও অবশিষ্ট আছে। তা থেকে বোঝা যায়, মন্দিরের শীর্ষক বা চুড়া নির্মিত হয়েছিল এই আলসের উপর। চুড়ার দু’পাশে উপবিষ্ট ভঙ্গিমায় ব্যাদিত-বদন দুটি সিংহ মূর্তি প্রায় অবিকৃত অবস্থায় আজও সেই প্রমাণ বহন করে চলেছে। অন্য কোনও অলঙ্করণ ছিল কি না, তা আজ আর দেখা যায় না।

পঙ্খের বেশ কিছু শিল্পকর্ম ছিল সামনের দেওয়াল জুড়ে। জ্যামিতিক এবং ফুলকারী নকশার কাজ ছিল। তবে, জীর্ণতার গ্রাস এবং বারংবার রঙের প্রলেপে, বর্তমানে সেগুলির সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান হয়েছে। এছাড়াও, চারটি স্তম্ভের তলার বেদী অংশেও কিছু অলঙ্করণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বেদীর সামনের অংশে, একটি করে চতুষ্কোণ প্যানেলে কিছু শিল্পকর্ম ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেগুলি এতটাই অস্পষ্ট যে বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়।

সাক্ষাৎকারঃ সর্বশ্রী ভবানী প্রসাদ পতি, নির্মল কুমার পতি, অমিয় কুমার পতি, পীযূষ কুমার পতি এবং অনুপ কুমার পতি—ধামতোড়।                                                              পথনির্দেশ—সাবেক ৬নম্বর হাওড়া-মুম্বাই জাতীয় সড়কের ডেবরা বাসস্টপেজ লাগোয়া ধামতোড়। বালিচক স্টেশন থেকেও ধামতোড় যাওয়া যাবে। হাইওয়ের সামান্য উত্তরে পতি বংশের মন্দিরটি অবস্থিত।

- Advertisement -
Latest news
Related news