নিজস্ব সংবাদদাতা: ২০০৭ সাল থেকে ডাঙায় দৌড়ে আর জলে সাঁতার কেটে রাজ্য এবং দেশের জন্য মেডেল এনেছেন ভুরি ভুরি কিন্তু এখন ঘরে চালের যোগান দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন জঙ্গলমহলের শ্রীকৃষ্ণ মাহাত। মুক ও বধির শ্রীকৃষ্ণের মেডেলের তালিকা দেখলে চমকে উঠতে হয়! রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় তাঁর সোনা আছে 83টি, জাতীয় স্তরে সোনা পেয়েছেন 31টি। এছাড়াও দুই স্তরে রূপো ও ব্রোঞ্জ তো রয়েইছে। ২০১২ সালে অংশ নিয়েছেন মুক ও বধিরদের জন্য উত্তর আমেরিকার টরেন্টো আ্যথেলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে। ২০১৫ সালে এশিয়া প্যাসিফিক গেমসে দেশের হয়ে গেছেন জাপান আর ২০১৭ সালে তুরস্কে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্ম অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এখন সব বেকার মনে হয় শ্রীকৃষ্ণের। একটা কাজ চায় সে, না’হলে যে টিকে থাকাই দায়।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের অংশ গোয়ালতোড়ের ২৮বছরের যুবক এখন মাঠে গিয়ে দৌড়াতেই ভয় পায়। প্র্যাকটিস করলেই তো খিদে পাবে প্রচুর। জমি আছে সামান্য কিছুটা কিন্তু বাবা ভরত মাহাত বৃদ্ধ হয়েছেন তাই মাঠে কাজ করতে পারেননা তাই ভোর ভোর ছুটতে হয় মাঠে। গোয়ালতোড় বাজারেএকটা ছোট চায়ের দোকান চালায় মা। মাঠের কাজ সেরে ছুটতে হয় মাকে সাহায্য করতে। মুক ও বধির শ্রীকৃষ্ণ টেক্সট ম্যাসেজে জানান, ‘ জমিতে আজকাল তেমন ফসল হয়না। বাবার খাটার ক্ষমতা কমে গেছে। করোনার জন্য টানা ৯ মাস এবং তারপর দফায় দফায় লকডাউন চায়ের দোকানের আয়ের ১২টা বাজিয়ে দিয়েছে। আর পারা যাচ্ছেনা লড়াই করতে। আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি। প্লিজ একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিন।”
জঙ্গলমহলের ডাহি তাঁকে দৌড় শিখিয়েছিল আর জঙ্গলমহলের জলায় শিখেছিলেন সাঁতার। সেই দৌড় আর সাঁতারে ভর করেই বাংলাকে এনে দেওয়া মেডেল এনে দেওয়া সোনার ছেলের এখন রাতে ঘুম হয়না দুশ্চিন্তায়। বলেন,” খুবেই দুঃখের বিষয় এত কিছু পুরস্কার আনার পরেও আমি কোন সরকারি সহায়তা পায়নি। সরকারের না মিলেছে কোনও আর্থিক পুরস্কার না কোন চাকরি, শুধু নিজের অদম্য জিদ, আক্লান্ত পরিশ্রম আর ঈশ্বরের দেওয়া এই শরীর কাঠামো এই নিয়েই এই জায়গায় টিকেছি।
কিন্তু আর পারছিনা, বাবাও বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, এখন সংসারের আর্থিক টানাপোড়নে মা-এর সাথে চা দোকান থাকতে হয়। প্র্যাকটিসের জন্য খাবার, দৌড়ের জুতো আর সংসারের খরচ চালাবো কী করে?”
সরকারি কোনও সহযোগিতা ছাড়াই আন্তর্জাতিক ময়দানে শ্রীকৃষ্ণ লড়েছেন দেশের জন্য। নিজের সেই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ২০১২ সালে যেবার টরেন্টোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য নির্বাচিত হলাম তখন নিজেকে আরও ভালোভাবে তৈরি করার আশায় বাবার সাথে সাই (Sports Authority of India) তে গিয়েছিলাম। ডিরেক্টর আমার সমস্ত কাগজপত্র জমা নিলেন। তার কিছুদিন পর জানালেন নিয়ম অনুযায়ী মুক ও বধিরদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। যখন কোচ এবং মাঠ খালি থাকবে তখন তুমি এসে প্র্যাকটিস করে যেতে পার। কিন্তু তার জন্য আমাকে নিজের খরচে কলকাতায় থাকতে হবে। এটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা বলে আমি সেই সুযোগই নিতে পারিনি। গ্রামের মাঠেই প্র্যাকটিস করে সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। এই প্রতিবন্ধকতা নিয়েই লড়ে গেছি আরও ৬বছর কিন্তু আর পারছিনা। বাবা-মা বুড়ো হয়েছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো দরকার।
সামনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেও দেশের হয়ে লড়তে চান শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু বাধা সেই দারিদ্র্য। একটা ছোটখাটো কাজ পাওয়ার জন্য নবান্নতেও নিজে গিয়ে দরবার করেছেন শালবনীর একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে আইটিআই পাশ করা শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু সাড়া মেলেনি। শ্রীকৃষ্ণ জানিয়েছেন, ‘ একটা চাকরির আশায় নবান্নে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার সাফল্যের তালিকা দেখে প্রশংসা পাব, পাব আশ্বাস। কিন্তু আধিকারিকরা জানিয়েছেন, এখন চাকরি নেই। খবর কাগজের দিকে নজর রাখতে বলেছেন, যদি ভ্যাকেন্সি বের হয়। অথচ প্রায় দেখেছি মঞ্চ থেকে বা হঠাৎই কাউকে চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। সেরকম একটা চাকরি কী আমি পেতে পারিনা?” শ্রীকান্ত বলেন, কৃতিদের জন্য সরকারের পক্ষে এক কালীন আর্থিক পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। আমি নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে গিয়ে তার জন্যও দরবার করেছি কিন্তু আমার ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি।”
দৌড়াতে দৌড়াতে কিংবা সাঁতার কাটতে কাটতে দেশ অথবা রাজ্যের জন্য বুকটা চওড়া হয়ে যেত শ্রীকৃষ্ণ মাহাতের। ভাবতেন দেশ কিংবা রাজ্য একদিন তাঁর এই নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর পরিশ্রমের মূল্য ঠিক চুকিয়ে দেবে। কিন্তু এখন ক্রমশ সেই ছাতি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এলাকার যে সব নেতানেত্রীরা একদিন পিঠ চাপড়ে তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতেন তাঁরা এখন দূর থেকে দূরে মিলিয়ে কালো বিন্দু হয়ে গেছেন আর শ্রীকৃষ্ণের সংসারের ভবিষ্যতেও যেন সেরকমই একটা বিন্দু নেমে আসছে। শ্রীকৃষ্ণ কথা বলতে পারেননা, তাঁর বুক থেকে প্রাণপনে ঠেলে উঠে আসছে একটাই চিৎকার, একটা কাজ দিন প্লিজ, একটা কাজ, ছোটখাটো একটা কাজ…