Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১১১।। মহেন্দ্রলাল সরকার।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

জাতীয় বিজ্ঞানচর্চার জনক
ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

তিনি ছিলেন তাঁর সময়ে কলকাতার অবিসংবাদী বিখ্যাত চিকিৎসক। একবার এক দরিদ্র রোগীর নিউমোনিয়া সারানোর জন্য রোগীকে এক গাড়ি খড় উপহার দেন। যাতে ফুটো চাল সারানো যায়। গল্প মনে হলেও আজীবন এমন অনেক সত্য ঘটনার উৎস যে বরণীয় মানুষটি — তিনি ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার (০২/১১/১৮৩৩ — ২৩/০২/১৯০৪)।
বাবা তারকনাথ সরকার যখন মারা গেলেন তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ। অসহায় মা অঘোরমণি হাওড়ার পাইকপাড়া স্থিত শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে এসে উঠলেন কলকাতায়। নেবুতলায়, বাপের বাড়িতে। তীব্র দারিদ্র্য ও অবহেলার পাহাড় সরিয়ে মাথা উঁচু করে লড়াই চালিয়েছেন মহেন্দ্রলাল। বিদ্যাসাগর রাতে পথ বাতির আলোয় পড়াশুনা করেছেন -এই কাহিনী সুপ্রচলিত। ডা. মহেন্দ্রলালকে একই অভিজ্ঞতায় বাঁচতে হয়েছে।

অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে কোনো বাধাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনি। হেয়ার স্কুলে (১৮৪০)পড়াশুনা। ১৮৪৯ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তখনও হিন্দু কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়নি। তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ১৮৬১ সালে মেডিসিন , সার্জারি , নার্সিং অনার্স সহ এল. এম. এস. পাশ করেন। ১৮৬৩ সালে হন এম. ডি.। সে বছর দুজন এম. ডি. হন। তিনি এবং ডা. জগৎবন্ধু বসু। বলা বাহুল্য যুগ্মভাবে এই দুজনই দ্বিতীয় এম. ডি.। প্রথম এম. ডি. হন ডা. চন্দ্রকুমার দে (১৮৬২) ।

প্রখ্যাত এলোপ্যাথি চিকিৎসক হিসেবে শুধু কলকাতা নয় ,এক সময় বাংলা জুড়ে ডা. সরকারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতায় ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হল। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন তিনি। পরে এই সংস্থার সহ সভাপতি হন। এখানেও তাঁর জীবনে নাটকীয় মোড় আসে।

১৮৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এক সভায় তিনি এলোপ্যাথির সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোকপাত করবার সাথে সাথে ডা. হ্যানিম্যান ও তাঁর হোমিওপ্যাথী চিকিৎসার প্রশংসা শুরু করেন। শুধু প্রশংসা নয়, গুণকীর্তন। ততদিনে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন – এদেশের বহু অসুখে এলোপ্যাথি নয় হোমিওপ্যাথী পদ্ধতিই বেশি কার্যকর।

আলটপকা কোনো মন্তব্য করে পরে ক্ষমা চেয়ে ঢোঁক গেলার পাত্র নন তিনি। আসলে মরগ্যানের “ফিলজফি অফ হোমিওপ্যাথী” বইটি পড়বার পর তিনি হোমিওপ্যাথির প্রতি আকৃষ্ট হন। চলে যান প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার রাজেন্দ্রচন্দ্র দত্তের কাছে। কিছুদিন তাঁর পাশে বসে চিকিৎসা পদ্ধতি ও ফলাফল নিরীক্ষণ করেন। ব্রিটিশ চিকিৎসকগণ এবং এ দেশীয় চিকিৎসকরা এলোপ্যাথীর এই ‘অবমূল্যায়ণ’ সহজে মেনে নেননি। তাঁকে অ্যাসোসিয়েশন থেকে বহিষ্কার করা হয়। অনেকে রুষ্ট হয়ে প্রকাশ্যে তাঁর বিরোধিতা ও কুৎসা প্রচার শুরু করেন। প্রায় এক ঘরে মহেন্দ্রলাল আত্মীয় ব্ন্ধু বান্ধবদের অনুরোধ উপরোধেও নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন বরং সেই বিশ্বাস প্রচারের জন্য বছরের শেষে প্রকাশ করেন ‘ক্যালকাটা জার্নাল অব মেডিসিন’।

এবার শুরু হল পাল্টা প্রচার। মহেন্দ্রলাল লিখেছেন I was sustained by my faith in the ultimate triump of truth. শুরু করলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। প্রথমে অসুবিধে হলেও ধীরে ধীরে পসার বৃদ্ধি পায়। সে সময় বত্রিশ টাকা ভিজিট নিতেন তিনি। অচিরেই কলকাতার শ্রেষ্ঠ হোমিওপ্যাথিক হিসেবে প্রসিদ্ধ হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হন (১৮৭০)। তাঁকে তাঁর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টর অফ ল (১৮৯০) উপাধি প্রদান করে।

হোমিওপ্যাথী চিকিৎসায় ব্যাপক সাফল্যে সাড়া পড়ে যায় চিকিৎসক মহলে। বহু সাহেব তাঁর কাছে ধারাবাহিক চিকিৎসা নিতে শুরু করেন। ব্রিটিশ শাসকের টনক নড়ে। অবশেষে ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ সরকার মহেন্দ্রলালকে কম্পনিয়ান্স অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার (CIE) সম্মান প্রদান করে। কলকাতার শেরিফ মনোনীত হন তিনি (১৮৮৭)। হন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটও ( ১৮৮৭)। এবার তাঁকে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য করা হয়।

তিনি ছিলেন জমিদার রানী রাসমণির গৃহ চিকিৎসক। সেই সুবাদে রামকৃষ্ণ অসুস্থ হলে চিকিৎসার দায়িত্ব পান মহেন্দ্রলাল। ইতিহাস বলে ১৮৮৫ সালের ১২ অক্টোবর প্রথম রামকৃষ্ণকে দেখতে যান তিনি। ভিজিট নেন ষোলো টাকা। তবে এরপর আর কোনদিন ফিজ নেননি। নাস্তিক ডাক্তার মহেন্দ্রলাল রামকৃষ্ণের সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্কে বাঁধা পড়ে যান। এক অমোঘ আকর্ষণে তাঁর কাছে চলে আসতেন। গুরু ও শিষ্যদের সঙ্গে তর্ক করতেন। আড্ডা দিতেন। এমনই একদিন নরেন্দ্রনাথের গলায় ভজন শুনে অভীভূত ডাক্তার খুশি হন এবং তাঁকে প্রাণভরা আশীর্বাদ করেন।

রামকৃষ্ণকে দেবতারূপে পূজা করবার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। আপাত রূঢ় আচরণ করতেন কখনো কখনো। আবার তাঁর চিকিৎসার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি ডাক্তারি বই ও জার্নাল কিনে স্টাডি করতেন । একবার খুব কাশি হচ্ছে বলায়, তিনি রামকৃষ্ণকে সর্ব -সমক্ষে বলেন -‘ আবার কাশি হয়েছে! তা কাশীতে যাওয়াই ভালো। যে অসুখ তোমার হয়েছে , লোকদের সঙ্গে কথা কওয়া হবে না । তবে আমি যখন আসব , কেবল আমার সঙ্গে কথা কইবে।’ রামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন ,সমাধি নয় মৃত্যু হয়েছে । অনুগামীদের সৎকারের জন্য দশ টাকা প্রদান করেন। ফটো তোলার ব্যবস্থা হয়। তবে শবানুগমন করেননি মহেন্দ্রলাল ।

কেশবচন্দ্র সেন তাঁর কাছে চিকিৎসা নিতেন। বিদ্যাসাগরের তিন ঘনিষ্ঠ ডাক্তারব্ন্ধু ছিলেন একজন দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় , দ্বিতীয়জন – নীলমাধব মুখোপাধ্যায় এবং মহেন্দ্রলাল সরকার। নানা সামাজিক আন্দোলনে বিদ্যাসাগর এবং মহেন্দ্রলাল একে অপরের পাশে থেকেছেন। কিন্তু এহেন বন্ধুত্ব একসময় নষ্ট হয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায় পরস্পরের। বিদ্যাসাগরের ছোট মেয়ের সেবার খুব অসুখ। ঈশ্বর চিঠি পাঠালেন ডা. সরকারের কাছে। মহেন্দ্রলাল সেই চিঠি নিয়ে টেবিলে রেখে দেন, পড়ে দেখেননি। পরে যখন পড়ে দেখলেন, তখন অনেকটা সময় চলে গেছে। ছুটে গেলেন বিদ্যাসাগরের বাড়ি। বিদ্যাসাগর বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে -অকপটে সত্য স্বীকার করেন। বেজায় চটে গিয়ে বিদ্যাসাগর সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তবে মুমূর্ষু বিদ্যাসাগরের শয্যাপার্শ্বে উভয়ের সম্পর্ক পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয় চোখের জলে ।

বাল্য বিবাহ রদে মহেন্দ্রলালের নিরলস প্রয়াস জারি ছিল। ১৮৭২ সালে ম্যারেজ আ্যক্ট থ্রি অনুযায়ী এদেশে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ষোলো নির্ধারিত হয়। নারীশিক্ষা প্রসারে ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে অবলা বসু যাতে ডাক্তারিতে ভর্তি হন ,সে বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। দেওঘরে স্ত্রীর স্মৃতিতে রাজকুমারী কুষ্ঠাশ্রম প্রতিষ্ঠা (রাজকুমারী দেবীর সাথে ১৮৫৫ সালে বিবাহ হয় )করেন তিনি। ১৮৮৮ সালে কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মহেন্দ্রলাল সরকার। এখানেই অসমের চা শ্রমিকদের দুরবস্থা বিষয়ে প্রস্তাব পেশ ও গৃহীত হয়। চা শ্রমিকদের কুলি শব্দ ব্যবহারে তীব্র আপত্তি ছিল তাঁর।

তবে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের চিরস্মরণীয় কীর্তি ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব্ সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা ।১৮৭৬ সালের ২৯ জুলাই এই IACS প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে তাঁর এই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান গড়বার প্রচেষ্টা শুরু হয় অনেক আগে। ১৮৭০ সালের ৩ জানুয়ারি ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় একটি প্রচারপত্র প্রকাশিত হয় সর্বসাধারণের সাহায্য প্রার্থনা করে। এগিয়ে আসেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রমেশচন্দ্র মিত্র, কেশবচন্দ্র সেন , ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর , জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় , প্যারিমোহন মুখোপাধ্যায় , যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর , রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সহ কয়েকজন বিদ্যোৎসাহী জমিদার। ভিজিয়ানগরমের মহারাজ সুস্থ হয়ে ডা. সরকারের হাতে ভিজিটের বদলে চল্লিশ হাজার টাকা নগদ তুলে দেন, গবেষণাগার নির্মাণের স্বার্থে। আজীবন সম্পাদক ছিলেন মহেন্দ্রলাল। তাঁর মৃত্যুর পর সুযোগ্য পুত্র অমৃতলাল সরকার সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানের বহুমুখী কর্মপ্রয়াস বৃদ্ধি করেন।

প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যায় এলোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। অথচ ডা.মহেন্দ্রলাল ছেলেকে বারণ করে দেন। হোমিওপ্যাথী ঔষধ সেবন করেছেন আমৃত্যু। নিজে ঈশ্বর মানতেন ,তবে মূর্তিপুজোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল – ‘বিশ্বাস অন্ধ এবং ধর্ম অযৌক্তিক ।এদের স্থান হৃদয়ে ,বুদ্ধির সঙ্গে এদের সম্পর্ক নেই’। মৃত্যুর ঠিক আগে ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন ‘কাঁদবার এ সময় নয় ,আমি উন্নততর লোকে যাচ্ছি’ ।

- Advertisement -
Latest news
Related news