শশাঙ্ক প্রধান: কথায় বলে, ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন!’ সে লোকে অনেক কিছুই বলে কিন্তু সব প্রবাদ যে শুধু জীবনে শ্লেষাত্মক হয় তারও কোনো মানে নেই। কোনোও কোনও হিসাবের বাইরে গিয়ে বিপরীত সত্য হয়ে যায়। আর যখন তা হয় তখন বলতেই হয়, ‘ভগবান যখন দেয় তখন ছপ্পড় ফুঁড়েই দেয়!’ আর তখন ছেঁড়া কাঁথাতে শুয়েই লাখ নয়, কোটি টাকার স্বপ্ন বাস্তব হয়ে যায়। ঠিক যেমনটা হল পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার অন্তর্গত হাজরাবাগান এলাকার একটা চায়ের দোকানের মালিক নাথু রানা আর তাঁর স্ত্রী কমলা রানার জীবনে।
কয়েকঘন্টা আগেই স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া আর চিৎকারে পাড়া মাত হয়ে গেছিল। ঝগড়ার কারন, সময় মত অবিক্রীত লটারির টিকিট ফেরৎ দেওয়া হয়নি এজেন্টকে। ফলে গচ্চা যেতে বসেছে সাড়ে ৩হাজার টাকা। একটা চায়ের দোকান থেকে কত আয় হয়? মেরে কেটে দিনে একশো টাকা। তার সঙ্গে সদ্য শুরু করা এই লটারির টিকিট বিক্রি করে না হয় আরও একশো। সব মিলিয়ে দিনে ২০০ টাকা। কিন্তু সেই মানুষকেই যদি সাড়ে ৩হাজার গচ্চা দিতে হয় তবে সংসারে অশান্তি হবেই।
বুধবার দুপুরে সেই নিয়ে তুমুল অশান্তি। সব দোষ ৬২ বছরের নাথুর। কেন সে আগেই এজেন্টকে জানালো না যে সাড়ে ৩হাজার টিকিট অবিক্রিত থেকে গেছে। দুজনেরই নাওয়া খাওয়া বন্ধ। কিন্তু আধঘন্টা যায়নি, সেই এজেন্টের কাছ থেকেই খবর এল, ‘যত্ন করে সব টিকিট রেখে দিন, ওই না বিক্রি হওয়া টিকিটেই লটারি লেগেছে ১কোটির!’ অতএব চল মন, বৃন্দাবন। লজ্জার মাথা খেয়েই নাতি নাতনির সামনে ৬২ বছরের বুড়ো জড়িয়ে ধরে ৫৮বছরের বুড়িকে। প্রেম যেন পুরো জমে ক্ষীর।
না, নাথু কিংবা কমলার জীবনটা এত সহজ ছিলনা আধঘন্টা আগেও। নিজেদের বাড়ি পিংলার টুঙুর গ্রামে। জমি জিরেত নেই, উপার্জন নেই। ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। নাতি নাতনি মিলিয়ে ৬ জনের সংসার দিনমজুরি করে চালাতে হিমশিম খায় ছেলে একা। ৪ বছর আগে বুড়োবুড়ি মিলে ঠিক করলেন বাড়ি থেকে ২কিলোমিটার দুরে ময়না-মুন্ডুমারী রাজ্যসড়কের হাজরা বাগান তেলপাম্পের কাছে একটা চা-পানের দোকান খুলে বসলেন। কিন্তু সে দোকান চলে কই?
নাথু রানা বলেন, ‘ একে গ্রামের লোকের হাতে কাঁচা পয়সা কম থাকে। তারওপর হাতের কাছেই জলচক, মালিগ্রাম বাজার। ফলে পথচারীরাও খুব একটা থামেনা। পেট্রোলপাম্পে তেল ভরতে এসে দু-চারজন দাঁড়ায়, টুকিটাকি কেনে। লকডাউন শুরু হতে তারও দফারফা হয়ে গেল। এখান থেকে বাড়িতে থেকে টাকা নেব কী বাড়িতে থেকেই চালটা, মুলোটা নিয়ে আসতে হয়। দোকানটা তুলেই দেব ভাবছিলাম। এই সময় একজন মাষ্টারমশাই আমাদের দোকানে চা খেতে আসলেন। কথায় কথায় নিজেদের দুঃখের কথা উঠল। সেই মাষ্টারমশাই বললেন চা পান দোকানের পাশাপাশি লটারির টিকিট বিক্রি করা শুরু করতে। সেই থেকে শুরু।’
নাথু রানা বলেন, ‘ নিয়ম অনুযায়ী যে টিকিট বিক্রি হয়না তা খেলা শুরু হওয়ার আগেই এজেন্টকে জানাতে হয়, এজেন্ট ডিলারকে জানায় এবং ডিলার জানায় কোম্পানিকে। ফলে ওই টাকাটা ফেরৎ হয়ে যায়। এই কদিন পিংলা, সবং, ময়না সর্বত্রই প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলছে। মানুষ বাড়ি থেকে বেরুতে পারছেনা। ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। মানুষ নিজেকে সামলাবেনা লটারির টিকিট কাটবে। ফলে অনেক টিকিট বিক্রি না হয়ে রয়ে যায়। আমাকে দিনের শেষে সে সব হিসাব রাখতে হয়। কয়েকদিন সেটা করতে গড়িমসি হয়েছে। বুধবার হঠাৎই মনে পড়ে আজকেই খেলা, না বিক্রি হওয়া টিকিটের কথা জানাতে হবে। আমরা ফোন করেই টিকিটের সিরিজ নম্বর জানিয়ে দেই। তাড়াহুড়ো করে হিসাব নিয়ে বসি। দেখি সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকার টিকিট রয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ডেবরার শুভশ্রী লটারি এজেন্সিকে জানাই। ওরা বলে, ‘খেলা শুরু হয়ে গেছে। ফলে আর টাকা ফেরৎ হবেনা। ওই টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে।’
বিষয়টি নিয়ে অশান্তি শুরু হয়ে যায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। সলজ্জ্ব কমলা রানা বলেন, ‘ ওঁর একটু আলসেমি রয়েছে। এই করব এই করব বলে কাজ ফেলে রাখে। আমি ক’দিন ধরেই বলছি হিসাব কর, হিসাব কর। ও ততই বলে, দেখি আর দু-একটা যদি বিক্রি হয়। এই ভাবে অত টাকার টিকিট রয়ে গেছিল! ভগবান যদি মুখ তুলে না তাকাতেন তাহলে কী হত বলুন।’ অবশ্য এরপর কমলা স্বীকার করেছেন স্বামীর ওই ভুলের জন্যই কোটি টাকার লটারি লেগেছে তাঁদের কপালে। কমলা বলেন, ‘প্রথমে তো খুব ঝগড়া ঝাটি করলাম। রাগে দুজনই খায়নি। আধঘন্টা পরেই এজেন্টের ফোন এল। লটারি লেগেছে না বিক্রি হওয়া টিকিটেই। মানে ও টিকিট আমাদেরই। তখন যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা।’
পিংলা থানায় গিয়ে নিজেদের টিকিট আর প্ৰয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে এসেছেন রানা দম্পত্তি। নাথু জানিয়েছেন, লটারির টাকায় একটা থাকার মত বাড়ি আর দোকানটা বড় করবেন। কমলা বলেন, আমি একটা ভগবানের মন্দির বানাতে চাই। বাকি টাকা রেখে দেবেন ব্যাঙ্কে ছেলে বউমা আর নাতি নাতনিরা যেন আর তাঁদের মত কষ্ট না পায়। যতদিন বাঁচবেন দোকান চালিয়ে যাবেন রানা দম্পত্তি। দুজনেই বলেছেন, ‘ভগবান হাত পা দিয়েছেন করে খাওয়ার জন্য। শুধু শুয়ে বসে থাকার জন্য নয়। যতদিন বাঁচব তাই কর্ম করেই বাঁচব।’ আর খবরটা ছড়িয়ে পড়ার ভিড় বাড়ছে দোকানে। রানা দম্পত্তিকে দেখার জন্য লোকে আসছে আর চা-পান খেয়ে যাচ্ছেন। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে কোটি টাকা! সেকি চাট্টিখানি কথা?