নিজস্ব সংবাদদাতা: বৃহস্পতিবার রাতে খড়গপুর মন্দিরতলা শ্মশানে ছাই হয়ে গেল শিক্ষক ও কবি চিত্তরঞ্জন সরকারের দেহ। প্রায় সবার অলক্ষ্যেই চলে গেলেন প্রবীণ এই বামপন্থী মানুষটি। প্রখর রসবোধ আর অজাতশত্রু চিত্তরঞ্জন সরকার রেখে গেছেন তাঁর অসংখ্য গুনগ্রাহী ছাত্রছাত্রীদের। মঙ্গলবার বাড়িতেই পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন ৮৩ বছরের মানুষটি। মাথায় গুরুতর চোট লাগে তাঁর। পরিবারের লোকেরা তাঁকে প্রথমে নিয়ে যান পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায় বড়মা হাসপাতালে। আঘাত গুরুতর হওয়ায় তখুনি চিকিৎসকরা তাঁকে কলকাতা স্থানান্তরিত করার পরামর্শ দেন। কলকাতার হাসপাতালেই বুধবার ভোরে মৃত্যু হয় তাঁর। যেহেতু আঘাত জনিত মৃত্যু তাই একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হয়। ময়নাতদন্ত ও পুলিশি তদন্ত শেষে তাঁর দেহ হাসপাতাল থেকে মুক্ত করতে বৃহস্পতিবার গড়িয়ে যায়। অতঃপর প্রায় গভীর রাতে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। পরিচিতরা তাঁকে গান্ধীদা বলে সম্বোধন করতেন।
খড়গপুর শহরের অতুলমনি পলিটেকনিক উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন চিত্তরঞ্জন সরকার। তাঁর আদি বাড়ি ডেবরা থানার রাধামোহনপুরে। পাঁচের দশকে ডেবরা এলাকায় বামপন্থী আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। এরপর চাকরি সূত্রে খড়গপুর শহর। পরে খড়গপুর শহরের কমলাকেবিন লাগোয়া এলাকায় নিজ বাড়িতে স্থায়ী বসবাস। এখান থেকে খড়গপুর পুরসভায় সিপিএম প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন, বামপরিচালিত পুরসভার অর্থবিভাগ সামলাতেন। তখন চেয়ারম্যান এম.এ.রহমান।
১৯৯৯-৯৫ খড়গপুর পুরসভার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন চিত্তরঞ্জন সরকার। ওই ৫বছরই চেয়ারম্যান ছিলেন তারপরই বাম পরিচালিত পুরবোর্ডের পতন ঘটে। কিন্তু ওই ৫বছরেই তিনি সমগ্র খড়গপুর শহরকে দিয়ে যান প্রথম নলবাহিত পানীয় জল সরবরাহের পরিকল্পনা। এর আগে বছরের ৩ মাস তীব্র জলকষ্টে ভুগতে হত প্রায় সমগ্র খড়গপুরকে। তাঁর আমলেই খড়গপুর শহর জুড়ে যে পাইপলাইন পাতা শুরু হয় আজ ২৮ বছর পরেও সেই পাইপলাইনই খড়গপুর শহরকে পানীয়জল সরবরাহ করে আসছে। বলতে দ্বিধা নেই, পরবর্তীকালে তৃনমূল পরিচালিত পৌরবোর্ডের আমলে যে দ্বিতীয় জলপ্রকল্প শুরু হয় তা কার্যত: অসম্পূর্ণ এখনও অবধি, অনেকটাই অকার্যকরও বটে।
যে জলপ্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল তাঁর আমলে তা সম্পন্ন হয় পরবর্তী কংগ্রেস পরিচালিত পৌরবোর্ডের সময়। সেই পৌরবোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন খড়গপুর শহরের বর্তমান তৃনমূল নেতা রবিশঙ্কর পাণ্ডে। রবিশঙ্কর পাণ্ডে সরাসরি চিত্তরঞ্জন সরকারের উত্তরসূরী। নিজের পূর্বসূরী সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে শ্রী পাণ্ডে জানান, ‘সব অর্থেই একজন নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন শ্রী সরকার। মানুষ হিসাবে অত্যন্ত সৎ ও দক্ষ। তাঁর আমলেই শুরু হয় খড়গপুর শহরের প্রথম জলপ্রকল্পটি।’ শুধু তাই নয় চিত্তরঞ্জন সরকারের আমলেই শুরু হয়েছিল নির্মল খড়গপুর বা খাটা পায়খানার বিলোপ সাধন। বস্তিবাসীদের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প শুরু হয় তাঁরই আমলে। শিক্ষক ও প্রশাসকের পাশাপাশি একজন কবিও ছিলেন মানুষটি। তাঁর কবিতার দর্শন খড়গপুরের বুদ্ধিজীবী মানুষদের কদর কেড়েছিল।
বৃহস্পতিবার তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে শশ্মানে উপস্থিত ছিলেন খড়গপুর শহর তৃনমূল কংগ্রেস সভাপতি দীপেন্দু পাল, কাউন্সিলর কল্যাণী ঘোষ। তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হন আইনজীবী অরূপ ভার্মা, কাউন্সিলর শ্যামল রায়। কলকাতা থেকে মরদেহ আনার ব্যাপারে তদারকি করেছেন তৃনমূল নেত্রী হেমা চৌবে। প্রায় সমস্ত বামপন্থী নেতা কর্মীরা হাজির ছিলেন। দুই সন্তানকে রেখে গেছেন শ্রী সরকার।