Saturday, July 27, 2024

স্মরণে বুদ্ধদেব গুহ! মনে প্রাণে বেঁচেছেন রাজার মতো।। আশিস মিশ্র

- Advertisement -spot_imgspot_img

আজীবন মেরুদণ্ড সোজা করে চলেছেন
মনে – প্রাণে বেঁচেছেন রাজার মতো                                                                                  আশিস মিশ্র                পার্থিব সমাজ – সংসারে বড়ো দুঃসময় এখন। একের পর এক প্রিয় মানুষের মৃত্যু বিষণ্ণ করে দিচ্ছে। আজ কথাসাহিত্যিক ও শিল্পী বুদ্ধদেব গুহর চলে যাওয়া সাহিত্য,শিল্প ও সংস্কৃতি জগতকে গভীর শূন্যতায় ডুবিয়ে দিয়েছে। কয়েক বছর আগে শারদোৎসবের সময় চলে গেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আর একটি শারদ-উৎসবের কয়েকদিন আগে বুদ্ধদেব গুহর প্রয়াণ! বাঙালির আর থাকছেই বা কী!

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

তাঁর সঙ্গে এক দশকেরও বেশি সময়ের স্মৃতি আমার। অনেকবারই অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটিয়েছি। ওয়াটারলু স্ট্রিটে তাঁর অফিসে, বালিগঞ্জে সানি টাওয়ারের ফ্ল্যাটে, শান্তিনিকেতনে তাঁর বাড়িতে, হলদিয়ার বইমেলা, বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসবে, হোটেলের রুমে আড্ডা হয়েছে। নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। রসিকতা করে কত কথা বলেছেন তিনি। নিজের বই নিয়ে সই করে উপহার দিয়েছেন। কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, বাঙালির অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি এখনো রসবোধ। সে দুখেও হাসে। আনন্দেও হাসে।

তাঁর বাড়ির আতিথেয়তা কখনো ভোলার নয়। কবে কখন যাচ্ছি, এটা নির্দিষ্ট হওয়া থাকলেই হলো। তিনি যেন অপেক্ষা করে বসে থাকতেন নিজের চেয়ারটিতে। আর সামনের দেয়ালে সাজানো একটি সাদাকালো ছবি। ঋতু গুহর। হাসিমুখে তিনি যেন সারাক্ষণ তাঁর প্রিয় মানুষটিকে দেখছেন! আমাদের দেখেই খুশী হতেন। বলতেন, এসো। আগে বসো। তারপর বলতেন, কী খাবে বলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সব আয়োজন সম্পূর্ণ হতো।

কয়েক বার তাঁর কলকাতার ফ্ল্যাটে তমালিকা পন্ডাশেঠ, আমি ও কমল বিষয়ী যাই। ২০১৫ সালে সংবাদ সাপ্তাহিক আপনজন পত্রিকার উদ্যোগে হলদিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির সত্যেন্দ্রনাথ বসু অডিটোরিয়ামে লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও সাহিত্য সম্মেলনে তিনি উদ্বোধক হয়ে আসেন।

তরুণ লেখকদের প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসা বরাবরই ছিলো। যেমন অণ্ডাল গ্রামের তরুণ কবি নিখিল পানডে তার একটি কবিতার বই ডাকেই পাঠিয়েছিল বুদ্ধদেব গুহর কাছে। সেই সময় ঋতু গুহর প্রয়াণ ঘটেছে। তিনি বিষাদে। তবুও নিখলকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠি এখন নিখিলের কাছে সম্পদ। কিম্বা রঞ্জন ও সুমন। এই দুই তরুণের প্রতিও তাঁর ভালোবাসা ছিলো আজীবন। কলকাতার বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে এই দুই সাহিত্যপ্রাণ তরুণকে সঙ্গে নিতেন।

বুদ্ধদাই বলতাম। মঞ্চে সঞ্চালনার সময় তাঁকে লালাদা বলেও সম্বোধন করেছি। আজ গোটা সারস্বত সমাজে শূন্যতা! তাঁর অনেক বইয়ের মধ্যে ‘ সারস্বত ‘ মাঝে মাঝে খুলে পড়ি। বাংলা সাহিত্যের অনেক ঘটনা অকপটে তিনি লিখে গেছেন। যে কোনো তরুণ লেখক ও সম্পাদকের কাছে বইটি অমূল্য সম্পদ।
আমার একটি কবিতার বই তাঁকে দিয়েছিলাম ২০১৭ সালে। তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখি, সেই বইটি তাঁর বইয়ের সেল্ফে রাখা। আমরা গেলে তাঁর বইপত্রের দিকেই নজর থাকতো বেশি। বলতাম, বুদ্ধদা এই বইটি চাই। তিনি বলতেন, ওটার কপি কম আছে। আর কোনটা চাও বলো। তিনি আমাদের অন্য বইতে সই করে দিতেন।
শেষের দিকে চোখের দৃষ্টি কমে আসায় লিখতে পারতেন না। বলতেন, আমি তো আর তেমন বড়ো মাপের লেখকই হতে পারলাম না। তবুও কেন যে আমাকে পাঠক পড়েন জানি না। সত্যি তাই। এখনো সাহিত্যের পাঠক একান্তে পড়েন
‘ মাধুকরী ‘ ‘ কোয়েলের কাছে ‘ ‘ কোজাগর ‘ ইত্যাদি। সেই কবে গ্রামের লাইব্রেরিতে সবেমাত্র ‘ চানঘরে গান ‘ এসেছে, আর দুপুরে একা একা গ্রন্থাগারিক বারীনদা সেই বইতে মুখ গুঁজে বসে আছে।

সেই আমাদের যৌবনকালের স্বপ্নের লেখককে পরবর্তী সময়ে এতো কাছে পাবো, এটা আমাদের বন্ধুরা কখনো ভাবিইনি। মনে হয়, নিজেদের আত্মজৈবনিক কথাগুলি যেন তিনি সব বলে দিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাওয়া। তিনি নিজেও বলেছেন, সমস্ত ভালো গল্প – উপন্যাস মানেই তা আত্মজৈবনিক। ‘ সারস্বত ‘ বইতে এমন অকপট ও সত্য স্বীকারোক্তি খুব কম লেখকই করতে পারেন। যা তিনিই লিখতে পেরেছেন। প্রতিষ্ঠান কীভাবে একজন উঠতি লেখককে শেষ করতে পারে,আবার ওপরেও তুলতে পারে। তিনি সেই প্রতিষ্ঠানকে পরোয়া করেননি। আজীবন মেরুদণ্ড সোজা করে চলেছেন। মনে – প্রাণে বেঁচেছেন রাজার মতো।

- Advertisement -
Latest news
Related news