Saturday, July 27, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৫২।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণালঝাড়েশ্বর শিব মন্দির, কানাশোল (থানা—আনন্দপুর, মেদিনীপুর)

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

চিন্ময় দাশ                                                                      এক গৃহস্থের কালো রঙের একটি দুধেল গাই। রোজ একটি প্রাচীন বটগাছের নীচে এসে দাঁড়ায়। আর, অবিরল ধারায় তার দুধ ঝরে পড়তে থাকে মাটিতে। এই আশ্চর্য ঘটনা প্রথম চোখে পড়েছিল গৃহস্থের রাখাল ছেলেটির। এলাকাটি সেকালের ব্রাহ্মণভূম পরগণার অন্তর্গত। জানা যায়, সেদিন রাতেই ব্রাহ্মণভূমের জমিদার আলালনাথ দে, ২৪ পরগণা জেলার আড়িয়াদহের জনৈক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ শীতলানন্দ মিশ্র, আর গাভীর মালিক গৃহস্থ—তিন জনেই মহাদেব শিবের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। বটবৃক্ষের তলায় আছেন এক অনাদি লিঙ্গ। তাঁকে যেন উদ্ধার করা হয়।

দেবাদেশ মতো, সেই অনাদি লিঙ্গ উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা এবং পূজার প্রকাশ করা হয়েছিল, বিগ্রহকে স্বস্থানে রেখেই। সেদিন ছিল ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথি। বঙ্গাব্দ ১০৩৬ সন, ইং ১৬২৯ সাল। দেবতার নামকরণ হয়—বাবা ঝাড়েশ্বর শিব। জমিদার আলালনাথ সেবাপূজার জন্য মন্দিরের লাগোয়া একটি জলাশয় প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলেন। ৩৭ বিঘা পরিমিত বিশালাকার জলাশয়টি তাঁর নামেই ‘আলালদীঘি’ নামে পরিচিত। পরে, তাঁর সহোদর ভাই নদীয়াল দে জলাশয়ের ভিতর একটি জলহরি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। মাকড়া পাথরের সেই সৌধটির অস্তিত্ব এখন আর নাই।

যাইহোক, ব্রাহ্মণভূম পরগণা নাড়াজোল রাজ্যের অধীন। এক সময় নাড়াজোলে জমিদার ছিলেন রাজা অযোধ্যারাম খান। জনৈক রামনারায়ণ জানা ছিলেন অযোধ্যরামের দেওয়ান। দেব-দ্বিজের অনুগত ধর্মপ্রাণ মানুষ। শূলরোগের হাত থেকে মুক্তি পেতে, মহাদেবের শরণ নিয়েছিলেন। আরোগ্য ল্যাব করে, অনিন্দ সুন্দর একটি মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন মানত শোধের সময়।

একটি প্রতিষ্ঠা ফলক আছে মন্দিরে, পূর্বদিকের দেওয়ালে। তা থেকে জানা যায়, ১৭৫৬ শকাব্দে (১৭৫৯ নয়), ১২৪১ বঙ্গাব্দের ৯ই জ্যৈষ্ঠ—অর্থাৎ ইং ১৮৩৪ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। ইটের তৈরি দক্ষিণ্মুখী মন্দিরটি পঞ্চ-রত্ন রীতির। দক্ষিণ ছাড়াও, পূর্ব ও পশ্চিম—তিন দিকে তিন-খিলানের দ্বারযুক্ত অলিন্দ। থম্ভগুলি ইমারতি রীতির। পশ্চিমেও একটি দ্বারপথ আছে। অলিন্দগুলির সিলিং টানা-খিলানের। গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে দুই প্রস্থ খিলানের মাথায় গম্বুজ রচনা করে।মন্দিরের রত্নগুলি শিখর রীতির। প্রতিটিতে রথ-বিভাজন করা। তবে, পীঢ়-ভাগ নাই। শীর্ষক অংশগুলি সুরচিত।

ঝাড়েশ্বরের এই মন্দিরের গৌরব তার অলঙ্করণের জন্য। অজস্র টেরাকোটা ফলকে মণ্ডিত মন্দিরটি। তিনটি দ্বারপথের মাথায় তিনটি বড় ফলকে, কার্ণিশের নীচ বরাবর দুটি সারিতে এবং দুই কোণাচের গায়ের দুটি খাড়া সারিতে ফলকের বিন্যাস। ফলকের মোটিফ হিসাবে দেখা যায়—কংস কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, বিষ্ণুর অনন্তশয্যা, দেবতাদের সমুদ্রমন্থন, সীতা উদ্ধারের জন্য সেতুবন্ধন, লঙ্কাযুদ্ধ, রামের রাজ্যাভিষেক, ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ, কমলে-কামিনী, বিষ্ণুর দশাবতার, পুত্রকন্যা সহ দেবী দশভূজা, রাসমণ্ডলচক্র  ইত্যাদি অজস্র ফলক, অজস্র।

সামনে দ্বিতীয় কার্ণিশের নীচে, শিবলিঙ্গ সহ, পীঢ়-ভাগ করা শিখর-রীতির একসারি ‘নিবেদন মন্দির’ রচিত আছে।  এছাড়াও, বড় বড় একক মূর্তি ফলক আছে অনেকগুলি। দুজন মোহান্ত, জমিদার, বাইজী, চতুর্ভূজ নারায়ণ, দ্বারপাল, ভিনিশীয় রীতির অর্ধোন্মুক্ত দরজার প্রান্তে দ্বারবর্তিনী রমণী, বিভিন্ন ভঙ্গীমার মিথুন-দৃশ্য ইত্যাদি। এগুলি স্টাকো-র কাজ। পঙ্খের কাজও আছে এই মন্দিরে।  মহাদেব ঝাড়েশ্বরের সাথে, দেবী দুর্গাও আছেন মন্দিরে। গর্ভগৃহে উত্তরের দেওয়ালে, বা-রিলিফ রীতিতে দেবীর অষ্টাদশভূজা মহিষমর্দিনী মূর্তি। বিপুল জনসমাগমে এয মন্দিরে গাজন, শিবরাত্রি, শ্রাবণী মেলা এবং দুর্গাপূজা হয় বিশেষ আড়ম্বরের সাথে।

মূল মন্দির ছাড়াও, মহাকাল ভৈরবের থান, ভোগমণ্ডপ, নাটমণ্ডপ ইত্যাদি আছে এখানে। ‘ছলন’ হিসাবে টেরাকোটার ঘোড়া নিবেদন করা হয় ভৈরবকে। ভোগমণ্ডপটি ইং ১৮৫১ সালে জনৈক সনাতন চৌধুরী গড়ে দিয়েছিলেন। মন্দিরটি ভারি সযত্ন রক্ষিত। চোখ চাওয়া মাত্রই বোঝা তা যায়। তবে, রাসায়ণিক রঙের ব্যবহারে, ইটের মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়—তত্ত্বাবধায়কদের এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

সাক্ষাৎকারঃ সর্বশ্রী সুনীল মিশ্র, আলোক মিশ্র—কানাশোল।পথ-নির্দেশঃ মেদিনীপুর শহর থেকে উত্তরমুখে বাঁকুড়া গামী রাস্তার শালবনি থেকে, কিংবা  কেশপুর বা গোদাপিয়াশাল থেকেও আনন্দপুর হয়ে, কানাশোল আসা যাবে।

- Advertisement -
Latest news
Related news