Saturday, July 27, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ১২৪ ।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল
                                চিন্ময় দাশ
সাগরেশ্বর শিব মন্দির, রাউত্রাপুর (থানা– রামনগর, মেদিনীপুর)

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ—দীর্ঘ সাড়ে চারশ’ বছর। মেদিনীপুর জেলার সিংহভাগ এলাকা ছিল কলিঙ্গ নৃপতিদের অধীনে। হরিচন্দন মুকুন্দদেবের মৃত্যু এবং কালাপাহাড়ের ওডিশা বিজয় পর্যন্ত। সে শাসন সমাপ্ত হতে তখনও ৫০-৬০ বছর বাকি। জনৈক সাগর রায় কলিঙ্গ-নৃপতির অধীনে একটি করদ রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। সময়টা ইং ১৫০০ সাল। তাঁর রাজ্য ছিল মেদিনীপুর জেলার একেবারে দক্ষিণে, ওডিশার লাগোয়া, বীরকুল পরগণায়।

অর্ধ শতাব্দী না যেতেই, ওডিশায় পাঠান শাসন কায়েম হয়েছিল। তবে, স্বল্প কিছুদিনের মধ্যেই, ভারত সম্রাট আকবরের সেনাপতি তোডর মল্ল পাঠান শাসক দায়ুদ খাঁন কররানিকে নিধন করেন। তার অল্প কিছু পরে, ১৫৯৩ সালে সেনাপতি মান সিংহ পাঠান দমন সম্পূর্ণ করে, ওডিশায় মোগল শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এসব বলা হোল, একারণে যে, এই প্রায় একশ’ বছর এবং ইং ১৭৬০ সালে ইংরেজ শাসন প্রবর্তন পর্যন্ত, পরের দেড়শ’ বছর মোগল শাসনেও, সাগর রায়ের বংশধরগণ নিরংকুশভাবে জমিদারী করে গিয়েছেন। ‘চৌধুরী’ খেতাবও ছিল এই বংশের।
রায়বংশের ষষ্ঠ পুরুষে পৌঁছে, বকেয়া রাজস্বের দায়ে, জমিদারীটি নীলাম হয়ে যায়। সেসময়ের জেলা কোর্টের সরকারী উকিল যাদবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জেলা কালেক্টর মি. স্ট্রেচী সাহেবের দেওয়ান, মলিঘাটির জমিদার, বৈদ্যনাথ চৌধুরীর অধিকারে যায় জমিদারীটি।

সাগর রায়ের জমিদারী প্রতিষ্ঠার পর সওয়া পাঁচ শ’ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সে বড় কম সময় নয়। সাগর রায়ের বংশটিও আর টিকে নাই। সাগর রায়, তাঁর বীরকুল জমিদারী এবং রায়বংশের সম্পর্কে প্রথম জানা যায় এক ইংরেজ কর্তার একটি বিবরণী থেকে। ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রথা প্রচলনের প্রাক্কালে, ১৭৮৭ সালে, সমস্ত জেলা কালেক্টরদের কাছে, জেলার ততকালীন জমিদারদের বিবরণ চাওয়া হয়েছিল। মেদিনীপুর জেলার কালেক্টর মি. হিউয়েট সাহেব রাজস্ব বিভাগে যে রিপর্ট পাঠিয়েছিলেন, তা থেকেই সাগর রায় এবং বীরকুল জমিদারীর বিবরণ পাওয়া যায়।

যাইহোক, ইতিহাস থেকে আমরা এবার মন্দির প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ১৫০০ সালে সাগর রায় জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেই, বর্তমান রাউত্রাপুর (জরীপ বিভাগের সরকারী নথিতে গ্রামের লিখিত নাম—রাউতারাপুর) গ্রামে শিবের এই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন। দেবতার নামকরণও করেছিলেন নিজের নামে—শ্রীশ্রী সাগরেশ্বর শিব।
মন্দিরের স্থাপত্য-রীতির বিষয়েও কয়েকটি কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। রাউত্রাপুর একেবারেই ওডিশা সীমান্তলগ্ন এলাকা। এই মন্দিরের গঠনশৈলীতেও ওডিশার গভীর প্রভাব।
শিখর-দেউল রীতির বহু মন্দিরে, বিমান বা মূল মন্দিরের সামনে, জগমোহন নির্মিত থাকতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও জগমোহনটি পীঢ়-রীতিতে নির্মিত হয়ে থাকে।
এখানে রাউত্রাপুরে মূল মন্দিরটিই পীঢ়-রীতিতে নির্মিত হয়েছে। কোন কোনও শাস্ত্রে এই রীতির দেউলকে ‘ভদ্র দেউল’ নামে উল্লেখ করা হয়।
মূল চারটি ভাগ এই মন্দিরের।

১. পিষ্ঠ বা পাদপীঠ— এই মন্দিরের পাদপীঠ আকারে উঁচু। পূর্বকালে এই অংশের গড়ন ঠিক কেমন ছিল, সঠিক বলা যায় না। সংস্কার কাজে সেসকল ঢাকা পড়ে গিয়েছে।
২. বাঢ় বা মন্দিরের নিম্নাঙ্গ—কলিঙ্গধারায় এখানে পঞ্চাঙ্গ বাঢ় রচিত হয়েছে। পা-ভাগ, তল-জঙ্ঘা, বন্ধন, উপর-জঙ্ঘা এবং বরণ্ড।
৩. গণ্ডী বা মন্দিরের উর্ধাঙ্গ—গণ্ডী দেখতে অনেকটা ভূমির সমান্তরালে মাথা-কাটা পিরামিডের মত। সেকারণে, এর কোণাচ অংশ বক্রাকার নয়, সরলরৈখিক। সমগ্র গণ্ডী অংশটি পাঁচটি সমান্তরাল অংশে ‘থাক’ (এরই নাম- পীঢ়) কাটা। নীচ থেকে দুটি থাক-এর পর, একটি পোতাল। তার উপর বাকি তিনটি।
৪. শীর্ষক বা মস্তক অংশ—প্রথমে একটি বেঁকি, তারপর খাপুরী, আমলক, ঘন্টা, কলস, এবং সবার উপরে ত্রিশূলদণ্ড স্থাপিত।
মন্দিরের গর্ভগৃহের সিলিংটি নির্মিত হয়েছে চতুষ্কোণ লহরা পদ্ধতি প্রয়োগ করে।
এই মন্দিরের চারটি অংশই একেবারে আদর্শ রীতি অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে।
ওডিশী শৈলীর আরও তিনটি প্রভাব আছে এই মন্দিরে—১. বাঢ় এবং গণ্ডী দুটি অংশ জুড়েই রথ-বিভাজন করা হয়েছে। মাঝখানে একটি রাহাপাগ, তার দুই দিকে দুটি অনর্থপগ বা অনুরথ এবং একেবারে দুই কোণায় দুটি কণকপগ বা কোণাপাগ—এই নিয়ে মন্দিরে পঞ্চ-রথ বিন্যাস করা।

২. পশ্চিম দিকের গণ্ডী অংশটিকে উদ্গত আকারে নির্মাণ করা। প্রকৃতপক্ষে সেটি ‘চাপা জগমোহন’ হিসাবে নির্মিত হয়েছে।
৩. এই জগমোহন অংশের মাথায়, একটি ‘ঝাপ্পা- সিংহ’ মূর্তি স্থাপির আছে। ওডিশার অধিকাংশ মন্দিরে যা দেখা যায়।
পরবর্তী কালে মন্দিরের সামনে একটি নাটমন্দির নির্মিত হয়েছে।

সাক্ষাৎকার: সর্বশ্রী নিমাই মাইতি, স্বপন জানা এবং হেমন্ত কুমার পণ্ডা—রাউত্রাপুর।
সমীক্ষাসঙ্গী: শ্রী জ্যোতির্ময় খাটুয়া, বালিসাই।
পথ-নির্দেশ: যে কোনও দিক থেকে বাস/ট্রেনযোগে দীঘা কিংবা রামনগর। সেখান থেকে মোটরেবল পথে দেউলীহাটে মন্দিরটি অবস্থিত।

- Advertisement -
Latest news
Related news