Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৫৪ ।। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

- Advertisement -spot_imgspot_img

বঙ্গলক্ষ্মীর বরপুত্র
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

বিনোদ মন্ডল

“প্রকৃতির রাজ্য বস্তুতই নিয়মের রাজ্য”                                                       ২৩ জ্যৈষ্ঠ ,১৩২৬ বঙ্গাব্দ। ইংরেজি ৬ জুন ১৯১৯।জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতায় ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ তার আগে ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেছেন। ব্রিটিশ শাসকের প্রতি প্রেরিত তাঁর প্রতিবাদ পত্র তাঁর মুখেই শুনতে চাইলেন এক ঘনিষ্ঠ ব্ন্ধু। বন্ধুটির মৃত্যু শয্যায় ছুটে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু হায়, কবির পাঠ শুনতে শুনতে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলেন ব্ন্ধু। বাড়ি ফিরে গেলেন কবি। পরে খবর পেলেন সেই সুন্দর ঘুম আর ভাঙেনি তাঁর বন্ধুর। এই অনুজপ্রতিম বন্ধুটি হলেন বঙ্গলক্ষ্মীর বরপুত্র রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী (২০-০৮ – ১৮৬৪ — ০৬-০৬- ১৯১৯)।
এই রামেণ্দ্রসুন্দরের প্রসন্ন মুখ কবিকে প্রসন্ন করত। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মনে করতেন খাঁটি মানুষ। রবীন্দ্রনাথের কর্ম পরিধি বিশ্বব্যাপ্ত। আর রামেন্দ্রসুন্দর তাঁর বঙ্গলক্ষ্মীর সেবায় আজীবন ব্যস্ত থেকেছেন। বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি,বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ছিল তাঁর স্বপ্ন ও সাধনার ভিত্তি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ তাঁর মহৎ কর্মক্ষেত্র। মনীষী হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মূল্যায়নে: ১। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ গঠন, ২। বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও ৩। সাহিত্য পরিষদের মন্দির প্রতিষ্ঠা। রামেন্দ্রসুন্দরের তিনটি প্রধান দিশহিতকর কাজের নিদর্শন।

ধাপে ধাপে তিনি সাধারণ সদস্য থেকে শুরু করে পরিষদের সভাপতি হয়েছেন। আর গবেষকরা সালওয়ারী দেখিয়েছেন,পরিষদের এমন কোনো সাংগঠনিক পদ ছিল না যাতে কোনো না কোনো সময় তিনি আসীন হন নি। অন্যতর সম্পাদক, কার্যকরী সমিতি সদস্য, পত্রিকা সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক,সহকারী সভাপতি, হিসাব পরীক্ষক, সাধারণ সম্পাদক (১৩১১ — ১৩১৮) এবং সভাপতি (১৩২৬)। সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে কাজ করেছেন, সেই সুবাদে অনেকের সাথে সখ্য হয় তাঁর। তবে সবচেয়ে স্মরণীয় যুগলবন্দী রবীন্দ্রনাথ ও রামেন্দ্রসুন্দর।
১৯০৫। বঙ্গভঙ্গ। উত্তাল বাংলা। তখন পরিষদের সম্পাদক রামেন্দ্রসুন্দর। কার্যকরী সভাপতি রবীন্দ্রনাথ। জাতিকে জাগানোর জন্য গৃহীত হল নানা কর্মসূচি। বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন আয়োজিত হল। শুধু কলকাতা নয়। দিকে দিকে। কাশিম বাজার থেকে ভাগলপুর। প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কাশিম বাজারের রাজা মনীন্দ্র নন্দীর পৃষ্ঠপোষকতায়। সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গভঙ্গের পর জাতীয় ঐক্য স্থাপনের প্রেরণায়, হিন্দু -মুসলমান সৌভাতৃত্ববোধ পুনর্জাগরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
রাখী বন্ধন উৎসব, পুঁথি সংগ্রহ অভিযান, গুণীজন সংবর্ধনা নানা কর্মসূচি। ১৩১৮ সালের ১৪ মাঘ (১৯১২) কবিগুরুকে সাহিত্য পরিষৎ সংবর্ধনা দিচ্ছে। তখনও তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি কিন্তু। রামেন্দ্রসুন্দরের দূরদর্শিতা আমাদের মুগ্ধ করে। আবার রামেন্দ্রসুন্দরের ৫০তম জন্ম তিথিতে কবিগুরু মানপত্রের বয়ান লিখেছেন -“হে মিত্র পঞ্চাশ বর্ষ পূর্ণ করিয়া তুমি তোমার জীবনের ও বঙ্গ-সাহিত্যের মধ্যগগনে আরোহণ করিয়াছ, আমি তোমাকে সাদর অভিবাদন করিতেছি ।’

কিন্তু আদতে মানুষটি ছিলেন বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র। মুর্শিদাবাদ জেলার জেমো কান্দি গ্রামে জন্ম। বাবার নাম গোবিন্দসুন্দর। মা – চন্দ্রকামিনী দেবী। ১৮৭৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জেমো রাজপরিবারের উত্তরসূরি রাজা নরেন্দ্র নারায়ণের কনিষ্ঠ কন্যা ইন্দুপ্রভা দেবীর সংগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কান্দি ইংরেজি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৮২), প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ এ (১৮৮৪),এবং পদার্থ বিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স সহ বি. এ (১৮৮৬) পাশ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিদ্যায় (১৮৮৭) এম .এ পাশ করেন। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি অর্জন করেন ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। অধ্যাপনার জীবন শুরু হয় রিপন কলেজে (১৮৯২) । পরে ঐ কলেজের অধ্যক্ষ (১৯০৩) পদে আসীন হন তিনি। আজীবন ঐ পদে বৃত ছিলেন। বর্তমানে যা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ।

মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কাজে পাগলের মত মেতে ওঠেন। সেইজন্যই কলম ধরা। সাধনা, নবজীবন, ভারতী পত্রিকায় প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় তাঁর। সেই সূত্রে রবীন্দ্র সান্নিধ্য। ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত হওয়া সত্বেও বেকনের মতো নিষ্ঠতায় মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করেছেন রাজরোষের তোয়াক্কা না করে ক্লাসে পড়ানোর সময় মাতৃভাষা ব্যবহার করতেন। দ্বিধাহীন চিত্তে নানা সংস্কৃত ও বাংলা শব্দকে পরিভাষা হিসেবে বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে গ্রহণ করেছেন। যেমন mass – বস্তু, lens – পরকলা ,prism -কলম, work – কাজ , tension – টান ইত্যাদি ।

ধুতি-পাঞ্জাবী আর খদ্দরের চাদর শোভিত
আনখশির বাঙালী এই বিজ্ঞানী মাতৃভাষায় বক্তৃতা করা যাবে না বলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ পর পর ফিরিয়ে দিয়েছেন। তৃতীয় বারে সফল হন। তিনিই প্রথম বাঙালী যিনি ,বাংলা ভাষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম প্রবন্ধ পাঠ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সে সময় ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দেশীয় অধ্যাপকরা মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহার করতেন না। রামেন্দ্রসুন্দর ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। স্বদেশ সাধক রামেন্দ্রসুন্দর বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে অখণ্ড বাংলায় অরন্ধনের ডাক দেন।সেই কর্মযজ্ঞে বাঙালি বীরাঙ্গনাদেরও আহ্বান জানিয়েছেন সাদর আগ্রহে। নারী জাতিকে দেশ সেবায় উদ্বুদ্ধ করতে রচনা করেন “বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা” ।
১৩১২ বঙ্গাব্দে “বঙ্গদর্শন” পত্রিকায় এই লেখাটি প্রকাশিত হয়। লেখক ছোট্ট পুস্তিকাটিকে অখণ্ড বঙ্গের গৃহলক্ষ্মীদের উসৎর্গ করেছেন। সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় তাঁর আন্তরিক আবেদন হৃদয় স্পর্শ করে- “বন্দেমাতরম l ….বাঙলার লক্ষ্মী বাংলাদেশে জুড়ে বসলেন। …. লোকের গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, গাল ভরা হাসি হল। ….. ধনে ধানে দেশ পূর্ণ হল। ….. বাঙলার মেয়েরা ঐ দিন বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রত নিল। ঘরে ঘরে সেদিন উনুন জ্বলল না। হিন্দু – মোছলমান ভাই ভাই কোলাকুলি করলে। হাতে হাতে হলদে সুতোর রাখী বাঁধলে। ঘট পেতে বঙ্গলক্ষ্মীর কথা শুনলে।”
পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিদ্যা নিয়ে চর্চার পাশাপাশি দর্শন ও বাংলাভাষা চর্চা করেছেন সমানতালে। ভাষাবিজ্ঞান নিয়েও তাঁর আগ্রহের অন্ত ছিল না। বাংলা – ভাষার ‘ধ্বনি বিচার’ এবং ‘বাংলা ব্যাকরণ’ পড়লে উপলব্ধি করা যায় ভাষা তত্ত্ব নিয়ে তাঁর অগাধ বৈদগ্ধ্য। ‘শব্দ কথা’ ,’না’ প্রবন্ধ দুটি যার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গে তিনিই সাহিত্যের ভাষা ও লৌকিক ভাষার তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছেন। প্রয়োগের ক্ষেত্রে কখন কোন পদ্ধতি অনুসরণযোগ্য সে বিষয়ে দিকনির্দেশ করেছেন। ‘ধ্বনি বিচার’ প্রবন্ধে বাংলা ভাষার শক্তির উদঘাটন করেছেন তিনি। এমনকি প্রতিটি বাংলা বর্ণের স্বতন্ত্র শক্তি নিয়েও আলোচনা করেছেন।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ছিল বলেই সারা বাংলায় মাতৃভাষা চর্চাতে জোয়ার আসে। এই পরিষদের জন্য ভবন নির্মাণের স্বপ্নকেও সাকার করেছিলেন তিনি। যে ভবনে যুক্ত হয় পুঁথিশালা ও চিত্রশালা। শুধু কি তাই ! পরিষদের দাবি ছিল বলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তর প্রদানের ভাষা মাধ্যম হিসেবে বাংলাভাষাও মনোনীত হয়। যে সোপান পেয়ে অর্জিত হয় ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’কে স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে গ্রহণের অধিকার । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যার পথ প্রদর্শক।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পঠন পাঠন শুরু হচ্ছে তখন ৫৫ বছরের চংক্রমন শেষ করছেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৯১৯)। সে এক দীর্ঘ লড়াই। উপাচার্য আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আচার্য্য দীনেশচন্দ্র সেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য । নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নতুন মহিমায় উদঘাটিত হল ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। সেই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দীক্ষান্ত ভাষণ পঠিত হল বাংলায়। কথক — ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ।

- Advertisement -
Latest news
Related news