Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৮৯ ।। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

প্রথা ভাঙার পথিকৃৎ
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

বিনোদ মন্ডল

২৭ ডিসেম্বর ১৮৬৬। গভর্নর লর্ড লরেন্সের বাংলোতে পার্টি চলছে। গোরা মেম ও সাহেবদের পাশাপাশি উপস্থিত আছেন ব্রিটিশরাজের সমর্থক খেতাবধারী জমিদারবৃন্দ। আচমকা কেটে গেল সুর। সেই পার্টিতে উপস্থিত হলেন এক ষোড়শী বঙ্গবধূ। পূর্ণগর্ভা। জানা গেল, তাঁর স্বামী নিজে উপস্থিত থাকতে না পারায় নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে স্ত্রীকে প্রেরণ করেছেন। আজকের দিনে যা স্বাভাবিক, মামুলি মনে হতে পারে। দেড়শো বছর আগের পরাধীন বাংলায় এই ঘটনা ছিল অভাবনীয়। রীতিমতো সমাজ বিদ্রোহ। তাই তাঁকে চিনতে পেরে ক্ষোভে রাগে লজ্জায় পার্টি ছেড়ে চলে যান পাথুরিয়াঘাটার জমিদার প্রসন্ন কুমার ঠাকুর। সেই অবিস্মরণীয় বিদ্রোহিনী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী (২৬.০৭.১৮৫০ — ০১.১০.১৯৪১)।

জ্ঞানদানন্দিনীর স্বামী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ ছেলে, ভারতবর্ষের প্রথম আই. সি. এস. সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। জ্ঞানদানন্দিনী জন্মেছিলেন যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামে। তাঁর মা ছিলেন নিস্তারিণী দেবী। শিক্ষায় দীক্ষায় বিদুষী। আত্মজীবনী লিখে গেছেন। বাবা- অভয় চরণ মুখোপাধ্যায় এর জীবনও যথেষ্ট বর্ণময়। বাংলাদেশে তখনও মেয়ে দেখবার রীতি চালু হয়নি। অধিকাংশেরই বিয়ে হয়ে যেত আট ন’ বছরের মধ্যেই। ধনী পরিবারের ক্ষেত্রে খেলনা নিয়ে তাদের বাড়ির দাসীরা যেত বধূ নির্বাচন করতে। জ্ঞানদানন্দিনীকে পছন্দ করেছিল এক দাসী। সম্ভ্রান্ত বাড়ির মহিলারা বাড়ি থেকে সচরাচর বেরোতেন না যে।
গায়ের রঙ ঈষৎ শ্যামলা। কাটা কাটা চোখ মুখ দেখে দাসীর পছন্দ হয়ে যায়। শাশুড়ী সারদা দেবী নববধূকে পালকি থেকে কোলপাঁজা করে তুলে অন্দরমহলে নিয়ে যান। তাঁর নিজের ভাষায় — ‘আমার এক মাথা ঘোমটার ভেতর দিয়ে তাঁর (শাশুড়ীর) সেই চাঁপাকলির মতো হাত দিয়ে ভাত খাওয়াতেন।’ সত্যেন্দ্রনাথ আদর করে ডাকতেন জ্ঞানুমণি। তাঁর সেজ দেওর হেমেন্দ্রনাথ নিয়মিত পড়ানো শুরু করেন। নিজে লিখেছেন, ‘আমার যা কিছু বাংলা বিদ্যা তা সেজ ঠাকুরপোর কাছে। মাইকেল প্রভৃতি শক্ত বাংলা বই পড়াতেন, আমার খুব ভালো লাগতো।’ বিলেত থেকে সত্যেন্দ্রনাথ চিঠিতে সুপারিশ করেন বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার তালিম যেন তাঁর স্ত্রীকে দেওয়া হয়।

আসলে ১৮৬১ সালে (যে বছর রবীন্দ্রনাথ জন্ম গ্রহণ করেন) সত্যেন্দ্রনাথের পড়া হয়ে যায় সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ -‘সাবজেকশন অব উইমেন।’ নারীপুরুষ সমানাধিকার নিয়ে লিখেছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল ও তাঁর স্ত্রী হেরিয়ট টেলর মিল। এই গ্রন্থই সত্যেন্দ্রনাথের অন্তরে স্ত্রী স্বাধীনতা বিষয়ক ভাবনাগুলিকে বিকশিত করে। তাই তিনি চিঠিতে লিখেছেন ‘তুমি যে পর্যন্ত বয়স্ক, শিক্ষিত ও সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে, সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে প্রবেশ করিব না’। এ যেন ঘরে বাইরে উপন্যাসের নিখিলেশের মনের কথা। যা অর্ধ শতাব্দী পরে লেখা হবে। সত্যেন্দ্র লিখেছেন — ‘আমার ইচ্ছা তুমি আমাদের স্ত্রীলোকের দৃষ্টান্ত স্বরূপ হইবে কিন্তু তোমার আপনার উপরই তাহার অনেক নির্ভর।’ বাস্তবে, স্বামীর ইচ্ছার যোগ্য মর্যাদা রক্ষা করেছেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।

আট বছর বয়সে ১২৬৬ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে বিয়ে হয় তাঁদের। পরে, বিলেত থেকে ফিরে বোম্বেতে নিজের কাছে স্ত্রীকে নিয়ে যান সত্যেন্দ্র। পালকিতে চেপে যান নৌ বন্দরে। পালকি সোজা ঢুকে যায় জাহাজে। নারী যে অসূর্যম্পশ্যা। সেই জ্ঞানদানন্দিনী দুবছর পরে অপরূপ বেশে কলকাতায় ফেরেন। শুরু হয় বাঙালি মহিলাদের নবজাগরণের নতুন জয়যাত্রা। আজকের দিনে একান্নবর্তী সংসার নেই বললেই চলে। প্রথম ঘর ছেড়ে ঘরণীসহ কর্মস্থলে গিয়ে বাঙালির বাসা বাঁধার স্বপ্ন-উড়ান শুরু এই দম্পতির হাত ধরে ।

১৮৭৭ সালে একা তিন সন্তানকে নিয়ে ইংল্যান্ডের বন্দরে পৌঁছে যান তিনি। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে এসে অবাক হয়ে যান জ্ঞানেন্দ্র মোহন ঠাকুর। এদিকে জ্ঞানদানন্দিনী তখন অন্তঃসত্ত্বা। পরে সেখানে হাজির হন সত্যেন্দ্রনাথ। এই সাহসিকার জীবনের সাথে নানা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার গল্প যুক্ত আছে। সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা হলো, ঠাকুর বাড়ির তিনতলার শোবার ঘরে মাঝরাতে ব্ন্ধু মনোমোহন ঘোষকে বউ দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কাহিনি। গবেষক চিত্রা দেব লিখেছেন ‘রাত্রিবেলা দুই ব্ন্ধু সদর পেরিয়ে অন্দরে প্রবেশ করলেন, সমান তালে পা ফেলে, যাতে পায়ের শব্দে কেউ ধরতে না পারে। তারপর ঘরে ঢুকে বন্ধুকে ঢুকিয়ে দিলেন মশারির মধ্যে। নিজেও শুয়ে পড়লেন। আর জ্ঞানদানন্দিনী? তিনি লজ্জায় কাঠ হয়ে ঘোমটা টেনে এক পাশে বসে রইলেন, মনোমোহনও তথৈবচ।’

সমসময়েই শাশুড়ি গঙ্গা স্নানে যেতেন যে পালকি চেপে, সেই পালকির কাহাররা পালকি সমেত গঙ্গায় তিনবার ডুব দিতেন। বোঝা যায়, কতখানি দুঃসাহসের পরিচয়বাহী এই ঘটনা। বাস্তবে, বোম্বে থেকে ফিরে জোড়াসাঁকোতে প্রায় একঘরে হয়ে যেতে হয়,তাঁকে! বাড়ির অন্য মহিলারা তাঁর সংগে অসংকোচে খাওয়া দাওয়া ও মেলামেশা করতে ভয় পেতেন। মুসলমান সমাজের মতো সম্ভ্রান্ত হিন্দু সমাজে পর্দানসিন থাকার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছেন এই দম্পতি। ধীরে ধীরে তাঁকে অনুসরণ করে ঠাকুর বাড়ির অন্য মহিলারা সাজ পোশাক পরে গাড়ি চড়ে বাইরে বেরোবার অধিকার পেলেন। বিশেষত: প্রাত্যহিক বৈকালিক ভ্রমণের রীতি শুরু করেন জ্ঞানদানন্দিনী। সেই থেকে বঙ্গললনারা সভা সমিতি, মজলিস, আড্ডায় অংশ নেওয়া শুরু করলেন।

‘লিথো প্রেস’ বসিয়ে বাড়ির ছোটদের অঙ্কনে উৎসাহ দেন তিনি। তাঁর সম্পাদনায় ‘বালক’ পত্রিকা শুরু হয়। যেখানে নিজে লিখতেন, লিখতেন রবীন্দ্রনাথও। নাতি সুবীরের জন্য দুটি রূপকথার নাট্যরূপ দেন। ‘সাত ভাই চম্পা’ ও ‘টাক ডুমা ডুম।’ ‘নাকের বদলে নরুন পেলাম টাক ডুমা ডুম ডুম’ এই জনপ্রিয় সংলাপটির স্রষ্টা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। ভারতী পত্রিকায় তাঁর দুটি মননশীল প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কিন্ডার গার্ডেন ও স্ত্রীশিক্ষা। মরাঠী থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন ‘ভাউ সাহেবের বখর’। ‘ইংরেজ নিন্দা ও স্বদেশানুরাগ’ নামে দেশপ্রেম মূলক প্রবন্ধ রচনা করেন।

শুধু নিজের লেখালেখি নয়, অন্যদের সৃজন প্রতিভা বিকাশের দিকেও সমান যত্নশীলা ছিলেন তিনি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হ্যাভেল সাহেবের সাথে দেখা করিয়ে দেন। এর ফলে পরবর্তীকালে ‘বেঙ্গল স্কুল’ চিত্রকলা আন্দোলন গড়ে ওঠে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্কৃত নাটক অনুবাদের পেছনেও তাঁর প্রেরণা কাজ করেছে। সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের বড় ভরসার স্থল ছিলেন তিনি।

বিলেতে গিয়ে প্রথমবার জ্ঞানদানন্দিনীকে অভিভাবিকা হিসেবে পান রবীন্দ্রনাথ। আদরের ঠাকুরপোর বিয়ের জন্য যশোর থেকে মৃণালিনীকে খুঁজে আনেন তিনিই। শুধু তাই নয় কবির পত্নী বিয়োগের পর (১৯০২) পরিবারের সুখে দুখে পরম আশ্রয় ছিলেন মেজ বউঠান। ‘রাজা ও রানী’ নাটকে রানী সুমিত্রার ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করেছেন। যা পাবলিক স্টেজের অভিনেত্রীদের উদ্বুদ্ধ করেছে। এ নিয়ে প্রসংশার পাশাপাশি নিন্দার ঝড়ও ওঠে সমাজে। যার নেতৃত্বে ছিল সেকালের বঙ্গবাসী পত্রিকা।

পাঁচ সন্তানের মা হলেও দুটি সন্তান দীর্ঘজীবী হন। ইন্দিরা দেবী ও সুরেন্দ্রনাথ। স্বামী একটি পর্যায়ে দেবেন্দ্রনাথের পাশে থেকে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনে মেতে থেকেছেন। সেই সুবাদে জ্ঞানদানন্দিনী প্রবর্তিত শাড়ি পরবার ধরনটিকে বলা হয় ‘ব্রাহ্মিকা শাড়ি’ বা ঠাকুর বাড়ির শাড়ি বা বোম্বাই দস্তুর।কাগজে বিজ্ঞাপণ দিয়ে রীতিমতো শাড়ি পরানোর তালিম দিতেন। শাড়ির সংগে সায়া-সেমিজ-ব্লাউজ-সোয়েটার- জ্যাকেট পরিধানের চল তাঁর প্রদর্শিত পথ। তাঁর অদ্ভুত শখের কারণে ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহলের ইতিহাস আজ সচিত্র পাওয়া সম্ভব হয়েছে। কেননা, তিনি ফটোগ্রাফার ডেকে এনে শাশুড়ি, জা, ননদ সহ বাড়ির অপরাপর মহিলাদের ফটো তুলিয়ে রাখেন।

১৯০৮ সালে রাঁচি বেড়াতে যান। জায়গাটা দারুণ পছন্দ হয়ে যায়। পরে গিয়ে মোরাবাদি পাহাড় কিনে রাস্তা বানান। সংগে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। পরিকল্পনা মতো পাহাড়ের ওপরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘শান্তিধাম’ এবং পাহাড়ের নিচে সত্যেন্দ্রনাথ তৈরী করেন ‘সত্যধাম’। এখানে স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত (০৯.০১.১৯২৩) বসবাস করেন। অবশেষে, ৯১ বছর বয়সে, ছেলে সুরেন্দ্রনাথের পাম এভিনিউর ‘লাল বাংলা’ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। রবীন্দ্র প্রয়াণের শোক তখনও বাঙালির কাটিয়ে ওঠা হয়নি।

- Advertisement -
Latest news
Related news