Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৫৭ ।। রমেশচন্দ্র দত্ত – বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

দেশপ্রেমিক
রমেশচন্দ্র দত্ত

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

বিনোদ মন্ডল

১৮৬৮। কলকাতা। সান্ধ্য খবরের কাগজের বিপণন বাড়িয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে শোরগোল ফেলল একটি ঘটনা। প্রেসিডেন্সী পাশ করা তিনটি মেধাবী ছেলে শহর থেকে গায়েব। কিছুদিন পর জানা গেল বাড়ি থেকে পালিয়ে তাঁরা জাহাজে চেপেছেন। গন্তব্য ইংল্যান্ড। কারা তাঁরা ?
বিহারীলাল গুপ্ত (১৮৪৯ — ১৯১৬) ,সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৮ — ১৯২৫) এবং দেশপ্রেমিক রমেশচন্দ্র দত্ত (১৩/০৮/ ১৯৪৮ —- ৩০/১১/ ১৯০৯)

তিনজনই জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের সংগঠক। নেতা। তাঁদেরই অন্যতম রমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন প্রসাশক, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ ও পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে আগ্রহী নেতা। ডেপুটি কালেক্টর বাবা ঈসামচন্দ্র এবং মা ঠাকামনির আদরে ও যত্নে মানুষ হয়েছেন তিনি। কিন্তু যখন ১৪ বছরের কিশোর তিনি, নৌকা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান (১৮৬১) তাঁর বাবা। যদিও এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ অনাথের যা পরিণতি হয় রমেশের জীবনে ততখানি বিড়ম্বনা ঘটেনি।কাকা শচীচন্দ্র তাঁর দায়িত্ব নেন। ১৮৭১ সালে আই সি এস ওপেন এক্জামিনেশনে থার্ড হয়ে দেশে ফিরে আসেন। আলিপুরের সহকারী ম্যাজিস্ট্রেটের পদে যোগ দেন। ব্রিটিশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসকের পদে আসীন থেকেও কীভাবে দেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করতে হয়, তার নানা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন রমেশচন্দ্র।

১৮৭৪ সালে নদীয়ার মেহেরপুরে এবং ১৮৭৬ সালে ভোলা জেলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তিনি অসহায় নিরন্ন মানুষগুলির ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে নিরলস ভূমিকা পালন করেন। শুধু তাই নয় অর্থনীতির মেধাবী ছাত্র হিসেবে সংকটের স্থায়ী মোকাবিলায় উদ্যোগ নেন। ১৮৯৩ সালে বর্ধমান বিভাগের কমিশনার পদে উন্নীত হন। মাত্র ৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত সরকারী প্রশাসকের চাকরি করেছেন। ১৮৯৪ সালে উড়িষ্যার বিভাগীয় কমিশনার হন। তিনিই প্রথম ‘নেটিভ’ যিনি এই উচ্চ পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৪০ সালে বরোদা রাজ্যের রেভেনিউ মিনিস্টার পদে যোগ দেন তিনি। ১৯০৮ সালে অত্যন্ত সম্মানজনক বিকেন্দ্রীকরণ কমিশনের সদস্য মনোনীত হন তিনি ।

সরকারি প্রশাসনে তাঁর পূর্বসূরি বঙ্কিমচন্দ্রের সংগে শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। শোনা যায়, বঙ্কিমচন্দ্রের অনুরোধেই উপন্যাস রচনায় উদ্বুদ্ধ হন তিনি। বঙ্কিমের ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯) উপন্যাসে স্বাদেশিকতার প্রথম সূত্রপাত বাংলা আখ্যান সাহিত্যে জায়গা করে নেয়। বঙ্কিমের কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে রচিত হয় ‘বন্দেমাতরম’ সংগীত যার সুর সংযোজন করেন ভাটপাড়ার যদু ভট্টাচার্য। বাংলার মানুষ উদ্বেলিত হন এই গানে। ১৮৭২ এ অনুষ্ঠিত হিন্দুমেলা স্বাদেশিকতার নতুন জোয়ার আনে। রমেশচন্দ্র তখন জঙ্গীপুর, মুর্শিদাবাদের এসিস্টেন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর। দেশে তখন বিদ্রোহের পর বিদ্রোহ ধূমায়িত হচ্ছে। সিপাহী বিদ্রোহ পরবর্তী অধ্যায়ে নানা কৃষক বিদ্রোহ – সন্নাসী বিদ্রোহ নিরন্ন কৃষকদের আন্দোলনে সামিল করছে। অনুভববেদ্য রমেশচন্দ্র লিখে ফেলছেন পর পর চারখানি আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস। ‘বঙ্গবিজেতা’ , ‘মাধবী কঙ্কন’ (১৮৭৭) ,’মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ (১৮৭৮) এবং ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’ (১৮৭৯)।’ মনে রাখা দরকার তখনো বঙ্কিমের ‘আনন্দ মঠ ‘(১৮৮২) ‘দেবী চৌধুরানী (১৮৮৪), ‘এবং বহু আলোচিত ‘সীতারাম’ (১৮৮৭) প্রকাশিত হয়নি। ফলে সেই যুগসন্ধিক্ষণে তাঁর রচিত উপন্যাস চারটি স্বাদেশিকতার নতুন পর্যায় তুলে ধরে ।

বঙ্গবিজেতা উপন্যাসে ইতিহাসের পটভূমিতে ইন্দ্রনাথ-বিমলার অনুচ্চার ভালোবাসা গতি দিয়েছে। সম্রাট আকবর তৃতীয়বার বিদ্রোহ দমন করতে রাজা টোডরমলকে বাংলায় পাঠান। তিনি শেষ পর্যন্ত এখানে সফল হন এবং শান্তি স্থাপন করেন, এই কাহিনী বঙ্গবাসীর মনে স্বদেশপ্রীতির বোধ জাগ্রত করে। দ্বিতীয় উপন্যাস মাধবী কঙ্কনে – শাজাহানের পুত্রদের মধ্যে বিবাদের ছবিটি চিত্রায়িত। সুজার সংগে আওরংগজেবের যুদ্ধ এবং সুজার পরাজয়, রাজা যশোবন্ত সিংহের পরাজয় এখানে বর্ণিত। রাজপুত জাতির বীরগাথা বর্ণনায় উপন্যাসটি ঋদ্ধ। এই উপন্যাসের শেষ পর্বে হেমলতা নরেন্দ্রকে বলে,’ নরেন্দ্র তুমি বীরপুরুষ, শত্রুকে জয় কর, দেশের মঙ্গল কর, পদাশ্রিত ক্ষীণের প্রতি দয়া করিও।’

তৃতীয় উপন্যাস মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাতে শিবাজীর শৌর্য এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ত্যাগ ও নিষ্ঠার সংগে রঘুনাথ -সরযুর প্রেম কাহিনী উপজীব্য। এই আদর্শ – হিন্দু স্বাজাত্যবোধ পুনর্জীবনে সাহায্য করেছে। রবীন্দ্রনাথ ও শিবাজীকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। রাজপুত জীবন সন্ধ্যায় মোঘলদের বিরুদ্ধে রাজপুতদের সংগ্রাম পটভূমি হিসেবে আধারিত। এখানে তেজ সিংহ – পুষ্পকুমারীর নিটোল প্রেম যথেষ্ট সুন্দর ভাবে বর্ণিত হয়েছে। এই উপন্যাস বাঙালীর নবজাগ্রত স্বদেশ ভাবনাকে উদ্বুদ্ধ করতে সহায়ক হয়েছে।
অর্থনীতিতে প্রাজ্ঞ এই মানুষটি স্বদেশ ও অর্থনীতি সহ নানা আর্থ সামাজিক বিষয় নিয়ে ইংরেজি এবং বাংলায় বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাসে তাঁর The Economic History of India গ্রন্থটি মাইলস্টোন ধরা হয়। এছাড়াও রামায়ণ ও মহাভারত এই দুটি ভারতীয় মহাকাব্যকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন তিনি। চাকরি ছাড়ার পর তিনি তখন ফুল টাইম লেখক। মাঝে কিছুদিন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছেন। সেই কাজের সহায়ক হয়ে উঠেছে ইংরেজিতে লেখা প্রশাসনিক গ্রন্থসম্ভার।

রমেশচন্দ্র দত্ত ভারতীয় রাজনীতির এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নরমপন্থী নেতা ছিলেন। তখন কংগ্রেস সবে দানা বাঁধছে। সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে লন্ডনের শিক্ষা তাঁকে প্রভূত সাহায্য করে। আই সি এস ডিগ্রির জন্য পড়াশুনোর সমান্তরালে লন্ডনের মিডল টেম্পল-এ আইন পড়েছেন তিনি। ফলে ব্রিটিশ সরকার বিরোধী আন্দোলনের রূপরেখা রচনায় সেই শিক্ষা কাজ দিয়েছে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন তিনি।
এতসবের ফাঁকে ১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন রমেশচন্দ্র দত্ত। তাঁকে সহায়তার জন্য যে দুজন সহসভাপতি নির্বাচিত হন, তাঁদের একজন কবি নবীনচন্দ্র সেন এবং অন্যজন হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!

- Advertisement -
Latest news
Related news