Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা- ৯৭ ।। নটী বিনোদিনী।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

মঞ্চ পটীয়সী
নটী বিনোদিনীবিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

উনিশ শতকের উত্তর কলকাতা আলো করে জন্ম নিলেন দুই বিশ্ব নাগরিক রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ। সমসময়ে হাতিবাগান রেড লাইট এলাকায় দিদিমার খোলার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গ রঙ্গালয়ের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী বিনোদিনী (১৮৬২/ ১৮৬৩)।
মা-দিদিমার আদরের নাম পুঁটি। ১৪৫ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের অভাব অনটন মাখা সংসারে একমাত্র ভাই ছেলেবেলায় মারা যায়। তারা জাতে ছিলেন বৈষ্ণব। সেকালে বৈষ্ণব-বালিকাদের কম বয়সে, শৈশবে বিয়ে হয়ে যেত। তার ও হয়েছিল। রীতি মেনে। তবে স্বামী তাকে ঘরে তোলেনি। তিনিও ঐ বাল্য স্বামীর মুখ দেখেননি কোনোদিন।
পাড়ার অবৈতনিক স্কুলে সামান্য পড়াশুনো হয়েছিল। শিখেছিলেন ইংরেজিও। ভাতের সংস্থান করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছেন। জোর করে থিয়েটারে পাঠিয়ে ছিলেন মা। তাঁর যখন নয় বছর বয়স তখন তাদের বাড়িতে ভাড়া আসেন গায়িকা গঙ্গামণি। এই মহিলার কাছে গানে তালিম নিয়ে একসময়ে মঞ্চে সুরের জাদু ছড়িয়েছেন বিনোদিনী ।

সেই সময়ে বাংলার ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনয় করতেন চারজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী। রাজা, ক্ষেত্রমণি ,লক্ষ্মী এবং নারায়ণী। বিনোদিনী অবাক হয়ে এদের অভিনয় দেখতেন এবং আশা ও স্বপ্নে বিভোর হতেন একদিন এঁদের মতো সফল মঞ্চাভিনেত্রী হবেন। তখন গঙ্গার ঘাটের ধারে রসিক নিয়োগীর বাড়িতে মহলা হত। লম্বা টানা বারান্দায় ছুটে বেড়াতেন বিনোদিনী। সেকালের সব প্রখ্যাত অভিনেতা বেলবাবু, মহেন্দ্র বাবু,অর্ধেন্দু বাবু, গোপাল বাবুরা তাঁকে অত্যন্ত স্নেহে ও সাহসে থিয়েটারের প্রাথমিক পাঠ দিয়েছেন।

রাধাগোবিন্দ কর ছিলেন ন্যাশনাল থিয়েটারের অবৈতনিক শখের অভিনেতা ( যাঁর নামে আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল)। তিনিই প্রথম বেণীসংহার নাটকে একটি অপ্রধান চরিত্রে বিনোদিনীর নাম প্রস্তাব করেন। দর্শক অভিনন্দনে মুখরিত হয় প্রেক্ষাগৃহ। ধীরে ধীরে অভিনয়ের উপযোগী বয়স ও বোধ প্রস্ফুটিত হতে থাকে তাঁর। প্রথম সাড়া জাগানো সাফল্য আসে ‘হেমলতা’ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে। নাট্য অন্ত প্রাণ বিনোদিনী লিখেছেন –‘ বাড়িতে থাকিতে মন সরিত না,কখন আবার গাড়ি আসিবে, কখন আমায় লইয়া যাইবে, তেমনি করিয়া নতুন নতুন সকল শিখিব, এই সকল সদাই মনে হইত। যদিও তখন আমি ছোট ছিলাম, তবুও মনের ভিতর কেমন একটা মধুর ভাব ঘুরিয়া বেড়াইত।’
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে পঁচিশ টাকা মাসিক বেতনে যুক্ত হন তিনি। পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় মাকে সংগে নিয়ে এই নাট্যদলের সংগে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও তীর্থ দর্শন করা হয়েছে তাঁর।তবে, গিরিশচন্দ্রের সান্নিধ্য ও শিষ্যত্ব গ্রহণের পর তাঁর অভিনয় জীবন সর্বার্থ সার্থক হয়ে ওঠে। স্টার থিয়েটারে অভিনীত ‘চৈতন্যলীলা’ আজ মিথে রূপান্তরিত। এই নাটকের প্রথম অভিনয় ২ আগস্ট ১৮৮৪ সাল। চৈতন্যদেবের ভূমিকায় বিনোদিনীর প্রাণ ঢালা অভিনয় দেখতে দূর দূরান্তের মানুষ হলে ভিড় করতেন।

বিনোদিনীর সৌভাগ্য-সেকালের তাবড় সাহিত্যিক ও নাট্যকারদের রচনা অবলম্বনে পরিকল্পিত নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী , কপালকুণ্ডলা মৃণালিনী, দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ, সধবার একাদশী , মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরোজিনী নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। গিরিশচন্দ্রের বহু নাটক তো আছেই। বারো বছরের সংক্ষিপ্ত অভিনয় জীবন তাঁর। এর মধ্যেই আশি খানারও বেশি নাটকে শতাধিক চরিত্রে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নাটকে। সেখানে চিত্রাঙ্গদা, প্রমীলা, সীতা, বারুণী, মহামায়া ও রতি চরিত্রে নিয়মিত অভিনয় করতে হতো। কখনো কখনো কোনো কোনো শিল্পীর অনুপস্থিতিতে আরো দু একটি চরিত্রে রূপদান করতে মঞ্চে হাজির হতেন হাসি মুখে।
গিরিশচন্দ্র ছাড়া বিনোদিনীর নাট্য প্রতিভার চরম উৎকর্ষভাব প্রস্ফুটিত হওয়া কঠিন ছিল। তিনি অপত্য স্নেহে বিনোদকে গড়ে পিটে নিয়েছেন। বিনোদিনীরও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। কিন্তু স্টার থিয়েটারের নামকরণকে কেন্দ্র করে থিয়েটারের রাজনীতির শিকার হন বিনোদিনী। সেই অভিমানে ও ক্ষোভে সম্ভবত নিজেকে অভিনয় জগৎ থেকে পুরোপুরি সরিয়ে নেন মাত্র ২৪ বছর বয়সে। ১৮৮৭ সালের ১ জানুয়ারি শেষবার মঞ্চায়নে উপস্থিত হয়েছিলেন আলোকবৃত্তে।
লোকমুখে তাঁর অভিনয় প্রতিভার কথা শুনে নাটক দেখতে হাজির হন রামকৃষ্ণ। ১৮৮৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের সে রাত বিনোদিনীর জীবনের পরম প্রাপ্তি। তাঁর অভিনয় দেখে রামকৃষ্ণ বলেন – “নকলে আসলের উদ্দীপনা হয়, সোলার আতা দেখলে সত্যিকারের আতা মনে হয়”। মুগ্ধ ঠাকুর অনির্বচনীয় প্রসন্নতায় তাঁর মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে বলেছিলেন- ‘মা তোমার চৈতন্য হউক”। রামকৃষ্ণ এর সাহচর্যে দেহমনের গ্লানি ও অবসাদ মুক্ত হয়েছেন তিনি। তাঁর কাছে প্রার্থনা করেছেন- ‘তুমি আপনি জাগাও মোরে তব সুধা পরশে’। অসুস্থ মুমূর্ষু রামকৃষ্ণকে দেখতে মেমসাহেবের ছদ্মবেশে শ্যামপুকুরের বাসায় হাজির হন বিনোদিনী। তবে ঠাকুরের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়নি। অমল আনন্দে ভরে ওঠে তাঁর মুখ।
বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। চৈতন্য লীলার অসাধারণ সাফল্যের খবর পেয়ে নবদ্বীপ থেকে ছুটে এসেছিলেন সেকালের প্রখ্যাত বৈষ্ণব পণ্ডিত মথুরানাথ পদরত্ন। ভারততত্ত্ববিদ খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ফাদার লাফো এই নাটক দেখে বিনোদিনীকে সস্নেহে অভিনন্দিত করেন। বিনোদিনীর বয়ান ‘তাঁর সেই সুন্দর প্রসন্ন ক্ষমাময় মূর্তি আমার ন্যায় অধম জনের প্রতি কি করুণাময় দৃষ্টি’। তাঁর নাটক দেখেছেন এডুইন আর্নল্ড ও কর্নেল অলকট। প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। ইংরেজি কাগজগুলোতে তাঁকে নানা বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। মুন অব দ্য স্টার কোম্পানি। ফ্লাওয়ার অব দ্য নেটিভ স্টেজ। প্রাইমা ডোনা অব দি বেঙ্গলি স্টেজ।
নানা টানাপোড়েনের মাঝে ব্যক্তিজীবনে ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন। অভিনয় ছেড়ে শান্তির সন্ধানে স্বামীসংগ লাভ করেছেন। সন্তানের মুখ দেখেছেন। তবে একমাত্র কন্যা শকুন্তলা মাত্র তের বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছে (১৯০৩)। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে স্বামীর মৃত্যু হয়। একই বছরে প্রয়াত হন নাট্যাচার্য্য গিরিশচন্দ্র। শান্তির খোঁজে আজীবন স্বামী অভেদানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠে সান্ধ্য প্রার্থনায় উপস্থিত থেকেছেন। তবে কলকাতার পেশাদার রঙ্গালয়ে কোনো নতুন নাটক মঞ্চায়িত হলে , গিয়ে বসেছেন পরম উত্সাহে ,সাইড স্ক্রিনের আবডালে। অভিনেত্রীদের উত্সাহিত করেছেন।
অভিনয়ের পাশাপাশি সাহিত্য সাধনায় ব্যপৃত ছিলেন তিনি। ‘ভারতবাসী’ পত্রিকায় বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ বিষয়ক পত্রাবলী দিয়ে লেখালেখির শুরু। প্রথম মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ হলো ‘বাসনা’ প্রকাশিত হয় চল্লিশটি কবিতা ও আখ্যায়িকার সংকলন হিসেবে। পরে প্রকাশিত হয় ‘কনক ও নলিনী’ কাব্য। তাঁর মুদ্রিত প্রথম গদ্যগ্রন্থ হল- ‘বিনোদিনীর কথা আমার কথা’। এছাড়া ও একটি অসমাপ্ত লেখার পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় যার শিরোনাম-আমার অভিনেত্রী জীবন।
অসাধারণ দক্ষতায় নামমাত্র কেতাবি শিক্ষায় শিক্ষিত এই মহীয়সী জীবনের নানা দিক, রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত এবং পর্দার আড়ালে থেকে যাওয়া মানুষগুলোর চরিত্রের বহুমাত্রিক ছবি তুলে ধরেছেন। চিরদুখী বিনোদিনী নাট্যমঞ্চকে কতখানি ভালবাসতেন,তার প্রমাণ মেলে অভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরীর স্মৃতিকথায় — নতুন বই হলে তো উনি আসতেনই…..মুখে হাতে তখন তাঁর শ্বেতী বেরিয়েছে,একটা চাদর গায়ে দিয়ে আসতেন….শুনেছি বাড়িতে পুজো অর্চনা লেগেই আছে,তবু থিয়েটার দেখতে ওর ঠিক আসা চাই ।
অসামান্য এই মানুষটি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ১২ ফ্রেব্রুয়ারি প্রয়াত হয়েছেন। বাংলা ২৯ মাঘ ,১৩৪৭। সেদিন ছিল মঙ্গলবার মাঘী পূর্ণিমা। সাথে সাথে অবসান হয়েছে গিরিশযুগের ।

- Advertisement -
Latest news
Related news