Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৯২।। ক্ষিতিমোহন সেন ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img
কবিগুরুর সাথে

ঋষিপ্রতিম
ক্ষিতিমোহন সেন
                      বিনোদ মন্ডল                                        ‘একা-নব-রতন ক্ষিতি মোহন
ভকতি রসের রসিক
কবীর-কামধেনু করি দোহন
তোষেণ তৃষিত পথিক’।
উপরোক্ত প্রশস্তি শ্লোকের রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সন্তান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ। দার্শনিক, পণ্ডিত। যাঁকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, তিনি ক্ষিতিমোহন সেন (০২.১২. ১৮৮০ — ১২.০৩. ১৯৬০)।
বেদ, উপনিষদ, তন্ত্র,ন্যায়, স্মৃতিশাস্ত্রে অ-সাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। সংগীত ও আয়ুর্বেদশাস্ত্রে তাঁর জ্ঞান ছিল তুখোড়। মধ্যযুগের সাধু-সন্ত, বাংলার আউল-বাউল, সুফী সাধকদের জীবনচর্যা এবং সৃজনভূমি ছিল তাঁর গবেষণার অগ্রাধিকার। তাই দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁকে ‘একা-নব-রতন ‘ আখ্যায় ভূষিত করেছেন। কবীর- দাদু- রজ্জাব প্রমুখের সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে নিরন্তর চর্চা করেছেন। ‘কবীর’ নামক ধ্রুপদী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁরই গুণমুগ্ধ মহাত্মা গান্ধী তাই তাঁকে ‘প্রাচীন ঋষিপ্রতিম’ অভিধায় অভিনন্দিত করেছেন ।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

বিক্রমপুরের সোনারঙ গ্রাম তাঁর পিতৃভূমি। বর্তমানে যা বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। তাঁর জন্ম প্রবাসে – কাশী নগরে। গঙ্গার কোলে, বিশ্বনাথের সান্নিধ্যে। বাবা ভুবনমোহন সেন পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। রত্নগর্ভা মা হলেন কিরণবালা সেন। কাশীর কুইন্স কলেজ থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃতে এম. এ. পাশ করেন ক্ষিতিমোহন। অসাধারণ ভাষা দক্ষতার জন্য শাস্ত্রী উপাধি অর্জন করেন। চম্পা রাজ এস্টেটের শিক্ষা সচিব হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন।

ডাক এল বিশ্বের আঙিনা থেকে। এল রুদ্রের আহ্বান। ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথের সৃজনযজ্ঞে পাশে থাকার প্রত্যয় নিয়ে হাজির হন। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের অধ্যক্ষ পদে আসীন হন ক্ষিতিমোহন সেন। তাঁর প্রথম পদার্পণের ঘটনাটি পরে বর্ণনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তখন ‘দেহলী’ ভবনে বাস করতেন। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান ধরেছেন ‘আপনি জাগাও মোরে’। ব্রহ্মসংগীত। স্মরণীয় মুহূর্তটিকে আজীবন স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি রেখেছিলেন ক্ষিতিমোহন।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী শ্রী সেন ছিলেন তন্নিষ্ঠ গবেষক, পুথি ও লোকগান সংগ্রাহক, শিক্ষক, সুবক্তা, অভিনেতা এবং সংগঠক। প্রথম যুগের অাশ্রমিক মুজতবা আলী শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ক্ষিতিমোহনের গুরুত্ব কতখানি বোঝাতে গিয়ে লিখেছেন – ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিধু শেখর শাস্ত্রীর মাঝখানের এক সেতু ক্ষিতিমোহন সেন। ‘এ প্রসঙ্গে পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যায়ণ স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন -‘ শান্তিনিকেতন আশ্রম ও বিশ্বভারতী পরিচালনার ক্ষেত্রে বিধু শেখর শাস্ত্রী ও ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দুই বাহু স্বরূপ – বুদ্ধদেবের দুই প্রধান শিষ্য সারিপুত্ত ও মৌদ্গল্যায়নের অনুরূপ রবীন্দ্রনাথের দুই শিষ্য ছিলেন বিধুশেখর ও ক্ষিতিমোহন।’

১৯০৮ সাল থেকে আমৃত্যু শান্তিনিকেতনে কর্মময় ব্যস্ত জীবন প্রসন্নতায় কাটিয়েছেন ক্ষিতিমোহন। তিনি লিখেছেন ‘আমরা ছিলাম মাটির তাল, গুরুদেব আমাদের হাত ধরে গড়ে পিটে তৈরী করে নিয়েছেন – তিনি না থাকলে আমরা কিছু হতাম না।’ শুধু আশ্রম বা বিশ্বভারতী পরিচালনা না, আরো বিচিত্র দায়িত্ব পালনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। প্রতি সপ্তাহে আশ্রমের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন কবিগুরু । আশ্রমবালক ও আশ্রমকন্যারা সেই ভাষণ শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। গুরুদেবের সেই সব কথামালা রেকর্ড করতেন তিনি ও অাশ্রমিক সন্তোষ কুমার মজুমদার। যা একটা মহান মানুষের রক্ত মাংসের জীবনকে যেমন মূর্ত করেছে, তেমনি একটি যুগের যন্ত্রণা, একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে ওঠার নানা পর্যায়কে ইতিহাসে স্মরণীয় করে রেখেছে।

কাশীতে শৈশব কৈশোর কাটানোর কারণে জ্ঞান সাধনার প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ ছিল তাঁর মধ্যে। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যে সহজাত নিবিড় অনুধ্যান ছিল তাঁর। পাশাপাশি আরবী ফারসী, গুজরাতি ও রাজস্থানী ভাষায়ও পণ্ডিত ছিলেন ক্ষিতিমোহন। রবীন্দ্রনাথ ও চারুচন্দ্রের আগ্রহে ‘প্রবাসী ‘পত্রিকায় নিয়মিত রসদ যোগাতেন মানুষটি। বিশেষত: এই পত্রিকার ‘হারামণি’ বিভাগে গ্রাম গঞ্জের নানা প্রচলিত লোকগান সংগ্রহ করে ছাপা হত। এখানে অসংখ্য বাংলা গান প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলির সংকলক ও সম্পাদক ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন।
শ্রী সেনের ক্ষেত্রীয় সমীক্ষা থেকে যা সংগৃহীত হত তার প্রথম দ্রষ্টা ও শ্রোতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকে বহু শিখ ভজন সংগ্রহ করেন তিনি। এমনই কয়েকটি ভজন অনুসরণ করে রচিত হয়েছে অসাধারণ সব রবীন্দ্র সংগীত। যেমন বাজে বাজে রম্য বীণা বাজে, এ হরি সুন্দর, আজি নাহি নাহি নিদ্রা আঁখিপাতে ,ইত্যাদি।

১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন চীন সফর করেন, তাঁর অন্যতম সফরসঙ্গী ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ – ৫৪ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতীর প্রয়োজনে অস্থায়ী উপাচার্য্যএর দায়িত্বভার অর্পিত হয় তাঁর হাতে। তাঁর রচনা সম্ভার বৈচিত্র্য ও বৈদগ্ধ্যে পরিপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন একটি মূল্যবান গ্রন্থ। এছাড়াও কবীর (১৯১১), ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা (১৯৩০), ভারতের সংস্কৃতি (১৯৪৩), বাংলার সাধনা (১৯৪৫), যুগপুরুষ রামমোহন (১৯৪৫), জাতিভেদ (১৯৪৬), বাংলার বাউল (১৯৪৭), হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ (১৯৪৭), ভারতের হিন্দু-মুসলমান যুক্ত সাধনা(১৯৪৯), প্রাচীন ভারতে নারী (১৯৫০), চিন্ময়বঙ্গ (১৯৫৭), রবীন্দ্র প্রসঙ্গ (১৯৬১), Hinduism (1963) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘ওয়ান হানড্রেড পোয়েমস ওফ কবীর'(১৯১৪ ) গ্রন্থটিও তাঁর সংগৃহীত দোহার ভিত্তিতে রচিত।
গবেষক শ্রুতি মুখোপাধ্যায় ‘ক্ষিতিমোহন সেন ও অর্ধ শতাব্দীর শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে দুই যুগ পুরুষের ব্যক্তি জীবনের সম্পর্ক এবং কর্মসাধনার সূত্রটিকে গ্রন্থায়িত করেছেন। তিন দশকেরও বেশি সময় রবীন্দ্রনাথের উষ্ণ সাহচর্য্য ক্ষিতিমোহনের মনন ও চিন্তনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলেছে। বিশেষত: তাঁর Hinduism গ্রন্থটি পাঠ করলে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সাথে সাযুজ্য অনুভব করা যায়। এই গ্রন্থটি ফরাসি, জার্মান এবং ডাচ ভাষায়ও মুদ্রিত হয়েছিল।

তাঁর একমাত্র সন্তান অমিতা সেন শান্তিনিকেতন আশ্রমেই বেড়ে উঠেছেন। বর্ণময় দীর্ঘ জীবনে নানা স্থানে কাটালেও আজীবন আশ্রমের সাথে যুক্ত থেকেছেন। নিজেকে আশ্রম কন্যা পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা ছিলেন অমিতা। শ্রাবণ মাসে জন্মেছিলেন। তাই কবি চিরকাল তাঁকে ‘শ্রাবণী’ নামে সম্বোধন করতেন। অধ্যাপক আশুতোষ সেনের সাথে বিয়ে হয় অমিতার। বিশ্ববন্দিত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ক্ষিতিমোহনের দৌহিত্র। এই অমর্ত্য নামটিও রবীন্দ্র- আরোপিত ।
পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথের সাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। সেই সব স্মৃতিকেই জীবনে পরম পুরস্কার প্রাপ্তি ভেবে তৃপ্তি পেয়েছেন। ১৯৪২ সালে রবীন্দ্র প্রয়াণের পরের বছর রবীন্দ্রস্মৃতি স্বর্ণপদক প্রাপক হিসেবে তাঁকেই শ্রদ্ধায় নির্বাচিত করে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। ১৯৫২ সাল থেকে ‘দেশিকোত্তম’ সম্মান প্রদান শুরু হয়। ক্ষিতিমোহন ছিলেন প্রথম দেশিকোত্তম।
ওয়ার্ধার হিন্দি ভাষা প্রচার সমিতি শ্রী সেনকে ‘মহাত্মা গান্ধী’ পুরস্কার (১৯৫৩) প্রদান করে । ঐ একই বছরে প্রয়াগে অনুষ্ঠিত হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে তিনি ‘মুরারকা পুরস্কার’ লাভ করেন।কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৪ সালে ‘সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক’ প্রদান করে ক্ষিতিমোহন সেনকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ।
কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, বিশাল রবীন্দ্র প্রতিভার আড়ালে ক্ষিতি মোহনের যথার্থ মূল্যায়ন চাপা পড়ে গিয়েছে। এই পর্যালোচনা আংশিক সত্য। আবার এটাও মনে রাখতে হবে ‘শান্তিনিকেতনের’ মতো উজ্জ্বল কর্মবিশ্ব পেয়েছিলেন বলেই ক্ষিতিমোহন সেন ক্ষিতিমোহন হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন।                                                                       নিষ্ঠুর সত্য হল, একুশ শতকের তরুণ বাঙালী প্রজন্ম তাঁকে চেনে- অমর্ত্য সেনের মাতামহ হিসেবে। তাঁর রচনা সম্ভার নিয়ে পঠন পাঠনের তেমন অবকাশ কোথায় বই-কুণ্ঠ নতুন প্রজন্মের বাঙালীর !

- Advertisement -
Latest news
Related news