কবি ও সমাজকর্মী
কামিনী রায়
বিনোদ মন্ডল
“করিতে পারিনা কাজ/ সদা ভয় সদা লাজ/ সংশয়ে সংকল্প সদা টলে/ পাছে লোকে কিছু বলে/ “কবিতার মোড়কে নীতিশিক্ষা ও আত্ম বিশ্লেষণের অমোঘ পাঠ দান যাঁর; তিনি অধ্যাপিকা কামিনী রায় (১২অক্টোবর ১৮৬৪—২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩)।
বরিশালের বাখেরগঞ্জে জন্ম। অধুনা ঝালকাঠি জেলার মধ্যে পড়ে তাঁর জন্মগ্রাম ‘বাসন্ডা’। ব্রাহ্মপিতা চণ্ডীচরণ সেন ছিলেন।ইতিহাস লেখক। পেশায় বিচারক। মা বামাসুন্দরী দেবী লুকিয়ে মেয়েকে বর্ণপরিচয় করিয়েছেন। ব্রাহ্মসমাজে তখন ভাঙনের উৎসব জারি আছে। কেশবচন্দ্র সেনের নাবালিকা কন্যার বিয়ে ব্রাহ্মসমাজের ফাটলকে দীর্ণ-দীর্ঘ করে তুলেছে। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে মদনমোহন ঘোষ, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী, দুর্গামোহন দাস প্রমূখ নেতা।
কেশববাবু ‘নববিধান’ ব্রাহ্ম সমাজের কর্ণধার। অপরদিকে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগক্তাগণ বাড়ির মহিলাদের এগিয়ে দিলেন। তাঁরা বঙ্গমহিলা সমাজ(১৮৭৯)প্রতিষ্ঠা করে নারী প্রগতির পথে বৈপ্লবিক দিশা দেখালেন। এই প্রথম মহিলারা পর্দার বাইরে বেরোতে শুরু করলেন। এই দলের নাম হলো-‘স্ত্রী স্বাধীনতা দল’। হালিশহর পত্রিকা কেশব সেনের দলের নাম দিলো-‘বক্তৃতামূলক দল’। বলাবাহুল্য কামিনী রায় স্ত্রী স্বাধীনতা দলের পক্ষে সওয়াল শুরু করলেন।
মূলতঃ ইংরেজ বালিকাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত কলকাতার বেথুন স্কুলে তিনিই প্রথম ভারতীয় বালিকা যিনি পড়াশুনা করেছেন, পরে সেখান থেকেই ভারতবর্ষের প্রথম নারী হিসেবে কামিনী ১৮৮৬ সাল নাগাদ বেথুন কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্স সহ বি. এ. পাশ করেন পরে এখানেই অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত হলেন। স্টাটুটারি সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায় তাঁর কবিতার প্রেমে পড়েন,পরে তাঁর পাণি প্রার্থী হন। ১৮৯৪ সালে উভয়ের বিয়ে হয়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে অপঘাতে মৃত্যু হয় কেদারনাথের।
ঠাকুরদা নিমচাঁদ সেনের স্নেহছায়ায় কামিনী বেড়ে উঠেছিলেন। তিনি ছোট্ট কামিনীকে কোলে নিয়ে কবিতা শোনাতেন। স্তোস্ত্রপাঠ শেখাতেন। একরত্তি মেয়ে অসম্ভব স্মৃতিধর ছিল। গড় গড় করে সব আবৃত্তি করে ফেলতো। ২৫ বছর বয়েসে(১৮৮৯) তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলো ও ছায়া’ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব যথেষ্ট। কেননা এর ভূমিকা লিখে দেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন গ্রন্থটিতে কবির আসল নাম প্রকাশিত হয়নি।লেখা হয়- জনৈক বঙ্গমহিলা ছদ্মনাম।
কামিনী রায় মুখ্যতঃ কবি। গীতিকবি। রবীন্দ্রানুসারী গীতিকবি। যদি ও খুঁতখুঁতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় প্রসাদ গুণের অভাব অনুভব করেছিলেন। ১৯০০খ্রিস্টাব্দের ৫অক্টোবর ব্ন্ধুবর প্রিয়নাথ সেনকে চিঠিতে লেখেন-“লেখিকার ভাব, কল্পনা এবং শিক্ষা আছে, কিন্তু তাঁর লেখনীতে ইন্দ্রজাল নেই,তাঁর ভাষায় সংগিতের অভাব”। অবশ্য ড. সুকুমার সেন তাঁর কাব্য চরিত্র বিশ্লেষণ করে লিখেছেন- “ভাবের ও ভাষার সংযম শালীনতা ইহার রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। হৃদয় দ্বন্দ্বের মধ্যে নৈতিক ও বৃহত্তর আদর্শের সংহতি অন্বেষণ ইহার কবিতার মর্মকথা।”
কামিনী রায়ের উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হলো নির্মাল্য (১৮১),পৌরাণিকী (১৮৯৭), মাল্য ও নির্মাল্য(১৯১৩),অশোক সংগগীত(সনেট মালা১৯১৪),অম্বা (নাট্যকাব্য১৯১৫),দীপ ও ধূপ (১৯২৯),জীবন পথে (১৯৩০) ইত্যাদি। অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা দুটি দীর্ঘ কবিতা মহাশ্বেতা ও পুণ্ডরীক তাঁর সমকালে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করে। এছাড়াও শিশুদের জন্য গুঞ্জন(১৯০৫)নামে তিনি একটি কবিতা সংগ্রহ প্রকাশ করেন। Some thoughts on the education of our Women নামে ও একটি মননশীল প্রবন্ধ লেখেন কামিনী রায়।
ব্যক্তিক ও সামাজিক নানা ঘাত প্রতিঘাতে তাঁর সৃষ্টি সম্ভার আন্দোলিত হয়েছে। পুত্র অশোকের বিয়োগ বেদনায় নাট্যকাব্যের আদলে অশোক সংগীত পরিকল্পিত। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। নিজের সহানুভূতি ব্যক্ত করে দীপ ও ধূপ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।
লেখালেখির সাথে সাথে নানা সামাজিক সংস্কার কর্মসূচীতে সাথে যুক্ত হন কামিনী রায়। নারীমুক্তির আকুতি বার বার তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। নারী নিগ্রহের সংবাদে কবি বিচলিত হয়েছেন বার বার। ‘নারী নিগ্রহ’ কবিতায় লিখেছেন-“পাষন্ডেরা যবে প্রবেশিয়া ঘরে/স্বদেশী বধূরে অপমান করে/তখন পাওনা লাজ?/…..হিন্দুর ধর্মের করিছ বড়াই/হিন্দু সভ্যতার বল তুল্য নাই;/সতী অতুলনা ভারতের নারী/বলি গর্ব করি ছাড়ি অত্যাচারী/সে সতীরে শাস্তি দাও/…”
সেকালের সমাজে পুরুষদের প্রাধান্য নারীর অগ্রগমণের পথ রুদ্ধ করেছে। কামিনী রায় বাস্তব সমাজে উপলব্ধি করেছেন পুরুষই নারীকে অবরুদ্ধ,অজ্ঞান ও দুর্বল করে রেখেছে। গৃহকর্মে নারীকে আটকে রেখে তার বিকাশ স্তব্ধ করে দিয়েছে। তাই তিনি আত্মসমীক্ষা করেছেন-“শক্তি মরে ভীতির কবলে /পাছে লোকে কিছু বলে ।”
পণপ্রথার নিষ্ঠুরতা বিশদ ভাবে প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি তীব্র ব্যঙ্গ কাব্য কথায় লিখেছেন-ওগো আমার তিনটে পাশ ওগো আমার বি. এ./ওগো আমার রক্তচক্ষু হরিতবরণ টিয়ে/…তোমায় ওরা সাধছে হাজার দশেক টাকা দিয়ে,/ওদের কন্যা উদ্ধার করবে খালি হাতে গিয়ে/ওদের দেওয়া গোরা-বাজনা আলোর মিছিল নিয়ে,/ওগো বিশ্ববিদ্যা জয়ী,বীরসিংহ বি. এ./থাক বেঁচে জীয়ে ।…(বর বরণের নতুন ছড়া)।
পুরুষতান্ত্রিক লিঙ্গভিত্তিক সমাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। এই অধিপতি সমাজে বসবাস করে শিক্ষা লাভ করেও নারীকে তিনি নারীর চোখে বিশ্লেষণ করেছেন,নারীর জন্য পুরুষের সমতুল অধিকার দাবী করেছেন। শুধু নিজে কলম ধরেই ক্ষান্ত হননি,সমকালীন অপরাপর মহিলাদের সৃজন কর্মে উৎসাহিত করেছেন। সেই অর্থে তাঁকেই ভারতের প্রথম নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ১৯২৩সালে বরিশাল সফর করেন কামিনী রায়। ঐ সময় কবি সুফিয়া কামালের সংগে দেখা হয় তাঁর। তিনি সুফিয়া কে নিয়মিতএকটা নির্দিষ্ট সময় ধরে সাহিত্য চর্চা করবার পরামর্শ দেন।
সেকালে মহিলাদের মুষ্টিমেয় অংশ যখন সবে বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে, জড়তা রন্ধ্রে রন্ধ্রে,তখন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হন কামিনী রায়। স্বভাবত:ই নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যুক্ত হতে হয় তাঁকে। এভাবেই নারী শ্রম তদন্ত কমিশনের সদস্য হন(১৯২২-২৩)কামিনী রায়। শেষ জীবনে ঢাকার হাজারিবাগ এলাকায় পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন। এখানেই তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয় ।