Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৮১, সরোজিনী নাইডু।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

বুলবুলে হিন্দ
সরোজিনী নাইডু
বিনোদ মন্ডল
“আমার মহান গুরুর আত্মা, আমার নেতার আত্মা, আমার পিতার আত্মা এখন শান্তিতে বিরাজ করুক। শুধুমাত্র শান্তি নয়, তাঁর ভস্মাবশেষ যেন চিরদিন জীবিত থাকে, এই ভস্মাবশেষের মধ্যে আছে চন্দন কাঠের সুগন্ধ। এই চন্দন কাঠ মিশ্রিত ভস্মাবশেষ দ্বারা আমরা যেন সমস্ত মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারি। মনে রাখতে হবে প্রতিটি ভস্মকণার মধ্যে আমার প্রিয় নেতার দেহ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এইভাবেই ভারত যেন তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ দেশে পরিণত হতে পারে। তাঁর মহান আত্মবলিদান যেন আমাদের স্বাধীনতার সংজ্ঞা এবং প্রজ্ঞাকে আরও দীর্ঘায়িত এবং মহান করতে পারে।”

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

গান্ধীজীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর লখ্নৌ শহরে, যুক্ত প্রদেশের তদানীন্তন রাজ্যপাল শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু যে অভিভাষণ প্রদান করেন তার সামান্য অংশ উদ্ধৃত হলো। সরোজিনী নাইডু (১৩-০২- ১৮৭৯ — ০২-০৩ – ১৯৪৯) ছিলেন তাঁর মহীয়সী মানসকন্যা। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি (১৯২৫)।

বাবা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়। মা বরোদা সুন্দরীদেবী। বাবার আদি নিবাস ছিল আজকের বাংলা দেশের বিক্রমপুর। গ্রামের নাম ব্রাহ্মণগাঁও। কর্মসূত্রে অঘোরনাথ হায়দ্রাবাদ শহরে সপরিবারে থাকতেন। বিশিষ্ট বিজ্ঞানসেবী এই মানুষটি ছিলেন নিজামের শিক্ষা উপদেষ্টা। সরোজিনীর মাও ছিলেন বিদুষী।নিয়মিত বাংলা ভাষায় কাব্যচর্চা করতেন। অত্যন্ত মেধাবিনী এই কিশোরী মাত্র বারো বছর বয়সে সবাইকে চমকে দিয়ে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাট্রিকে প্রথম হন।

মায়ের মতো কবিতাচর্চা ছিল সরোজিনীর ধ্যান জ্ঞান স্বপ্ন। কিংবদন্তি রয়েছে গণিত বইয়ের মধ্যে ১৩০০ লাইনের একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন তিনি। যা প্রথমে তাঁর বাবার করতলগত হয়। বিস্মিত অঘোরনাথ বড় মেয়ের সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে হাজির হন নবাব দরবারে। হায়দ্রাবাদের নবাব খুশি হয়ে সরোজিনীর পড়াশুনার জন্য বৃত্তি মঞ্জুর করেন। বিলেতে চলে গেলেন সরোজিনী। প্রথমে লন্ডনের কিংস কলেজ, পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত গ্রিটন কলেজে উচ্চ শিক্ষায় (১৮৯৫ – ৯৮) শিক্ষিত হন তিনি।
উনিশ বছর বয়সে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে হয় তাঁর। স্বামীর নাম মুথাইলা গোবিন্দরাজুলু নাইডু। বাবা মা উদারমনা ছিলেন। সহজে মেনে নেন এই বিয়ে। চার সন্তানের গর্বিত মা ছিলেন তিনি। তাঁরা হলেন জয়সূর্য, পদ্মজা, রণধীর এবং লীলামণি। এঁদের মধ্যে পদ্মজা নাইডু সবচেয়ে বেশি প্রতিভাময়ী ছিলেন।

শুধু বাংলা কিংবা ইংরেজি নয়, উর্দু এবং তেলেগু ভাষায় সমান দক্ষ ও স্বচ্ছন্দ ছিলেন সরোজিনী। ছোট ছোট আকারের অপরূপ সুন্দর কবিতা লিখে মুগ্ধ করতেন পাঠককে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে। ইংরেজিতে লেখা The Golden Threshold. এই প্রথম গ্রন্থটি তাঁকে বিশাল পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা প্রদান করে। তখনই লোকসাধারণ তাঁকে ‘বুলবুলে হিন্দ’ অভিধায় অভিনন্দিত করেন ।
শোনা যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর কবিতার নিয়মিত পাঠক। এ ছাড়াও জওহরলাল নেহেরু, গোপাল কৃষ্ণ গোখ্লে, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তাঁর কবিতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতেন। গোপালকৃষ্ণ গোখ্লে তাঁকে অনুরোধ করেন এদেশের হাজার হাজার গ্রামের অগণিত মানুষের মধ্যে গিয়ে তিনি যাতে কবিতার মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বপ্ন বীজ বপন করেন। সরোজিনী সেই চেষ্টাও বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে গ্রামে গ্রামে সফর করেন ।

তাঁর সমসময়ে দেশে বিদেশে কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। ১৯১২ সাল নাগাদ প্রকাশিত হয় The bird of Time : Songs of Life, Death and the Spring .তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ The Brocken Wing, Songs of the Love, Death and the Spring. এই সব কাব্য নামেই মালুম হয় কেন তাঁকে বলা হতো ‘দ্য নাইটিঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া’। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয় The sceptered Flute :Songs of India এবং মৃত্যুর এক দশকেরও বেশি সময় পরে ১৯৬১ সালে The Feather of the Dawn প্রকাশিত হয় ।
১৯০৫ সাল । বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শরিক তিনি। তবে পাকাপাকি ভাবে কংগ্রেস পরিবারে যুক্ত হতে লেগে যায় আরও একটি দশক, ১৯১৫ সাল। জওহরলালের সাথে সাক্ষাৎ ১৯১৬ তে। মহাত্মার সাথেও। গান্ধীজীর সংগে যোগাযোগের পর জীবনের ধারা বদলে যায় কবি সরোজিনীর। সারা দেশে ঘুরে ঘুরে দেশের মানুষের দুরবস্থা উপলব্ধি করেন তিনি। অবহেলিত নারী সমাজকে জাগ্রত করবার দুরূহ কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১৭ সালে নারীর ভোটাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে যখন অ্যানি বেসান্ত উইমেন ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন গঠন করছেন তখন তিনি তাঁর পাশে বিশ্বস্ত সহযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
চম্পারনে নীল চাষিদের পক্ষে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার রাউলাট আইন জারি করে তথাকথিত রাজদ্রোহী রচনা প্রকাশ নিষিদ্ধ করে। যার প্রতিবদে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সরোজিনী সেই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। গান্ধীজীর নির্দেশে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অল ইন্ডিয়া হোমরুল ডেপুটেশনের সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ডে গমন করেন।

মহাত্মার একনিষ্ঠ অনুগামিনী সরোজিনী নাইডু ১৯২৫ সালে কানপুর অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই প্রথম মহিলা, যিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বে ভূষিত হন। ১৯২৮ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে ফিরে নতুন উদ্যমে নিজেকে অহিংস আন্দোলনে যুক্ত করেছেন। ১৯৩০ সালে গুজরাটে বাপুজির নেতৃত্বে লবণ সত্যাগ্রহ শুরু হলো। সেখানেও পুরোভাগে তিনি। শুধু তাই নয় গান্ধীজী কারারুদ্ধ হলে এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। ঘটনাচক্রে এই সময় তাঁকেও দু’দুবার কারারুদ্ধ হতে হয়।

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর যে ঘনিষ্ঠ বৃত্ত ছিল ,কংগ্রেস রাজনীতির থিংকট্যাঙ্ক, সেখানে জায়গা করে নিয়েছিলেন সরোজিনী নাইডু। দেশ স্বাধীন হওযার পর বাপুজির ইচ্ছায় তাঁর প্রিয়তম শিষ্য জওহরলাল প্রধান মন্ত্রী এবং ব্ন্ধু রাজেন্দ্র প্রসাদ হলেন রাষ্ট্রপতি। অন্যতম বিশ্বস্ত ব্ন্ধু বল্লভ ভাই প্যাটেল প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপ প্রধানমন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব পালন করেন। সরোজিনী নাইডু যুক্ত প্রদেশের রাজ্যপাল ( অধুনা উত্তর প্রদেশ) নিযুক্ত হন ।
গান্ধীজির সাথে তিন দশকের গভীর অনুষঙ্গ ছিল তাঁর। বাপুজী চিঠিতে তাঁকে প্রিয় বুলবুল, প্রিয় মীরাবাঈ, আম্মাজান এমনকি মা সম্বোধনে নন্দিত করেছেন। তিনি তাঁর প্রিয় পিতাকে তাঁতী, লিটিল ম্যান, মিকি মাউস, প্রভৃতি আখ্যায় ভূষিত করেছেন চিঠিতে।
গান্ধীহত্যার আঘাত তাঁকে মর্মাহত করেছিল। রাজ্যপাল হিসেবে অফিসে কর্মরতা থাকার সময়েই হৃদরোগে আক্রান্ত হন সরোজিনী নাইডু। প্রয়াত হন দেশের জন্য উৎসর্গীকৃতপ্রাণ এক মহান সংগ্রামী কবি ।

- Advertisement -
Latest news
Related news