যুগপুরুষ
রাজনারায়ণ বসু
বিনোদ মন্ডল
ঊনবিংশ শতকের বাংলা নব জাগরণের ইতিহাসে যুগ পুরুষ রাজনারায়ণ বসুর নাম স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত রয়েছে। তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক, বিশিষ্ট চিন্তক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর মহাজীবন ব্যাপী অবদানের জন্য তাঁকে গবেষকগণ ‘Grand Father of Indian Nationalism’ অভিধায় অভিহিত করেছেন ।
অধুনা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বোড়াল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন রাজনারায়ণ বসু (০৭সেপ্টেম্বর ১৮২৬ — ১৮সেপ্টেম্বর ১৮৯৯) হেয়ার স্কুল এবং হিন্দু কলেজে পড়াশুনা করেন। ১৮৪৬ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন। যার ফলে তাঁকে, বোড়াল গ্রাম, তাঁর আদরের প্রিয় জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হতে হয়।
কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে বদলি হয়ে যান মেদিনীপুর গভর্নমেন্ট জিলা স্কুলে। বর্তমানে যা মেদিনীপুর কলিজিয়েট স্কুল নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। এখানে তিনি ছিলেন প্রধান শিক্ষক। কার্যকালের মেয়াদ ২১-০২- ১৮৫১ থেকে ০৬-০৩- ১৮৬৬। তিনিই প্রথম দেশীয় প্রধান শিক্ষক। তাঁর আগে এখানে সিনক্লেয়ার সাহেব ঐ দায়িত্বে আসীন থেকে সেকালে ৩০০ টাকা বেতন পেতেন। শ্রী বসুকে দেওয়া হয়, যার অর্ধেক ১৫০ টাকা। তবে সাহেবের বাংলো টি তাঁর বসবাসের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
রাজনারায়ণের হাতে দায়িত্ব ভার অর্পিত হওয়ার পর পাঠদান পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। একমুখী ভাষণ পদ্ধতি পরিত্যক্ত হয়। তিনি ছাত্রদের শ্রেণিকক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালনে সমর্থ হন। তাঁদের কণ্ঠস্বর যাতে বিষয়ভাবনাকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে তোলে সে বিষয়ে উদগ্রীব হন। ছাত্রদের মধ্যে সমসময়, ধর্ম জিজ্ঞাসা, সমাজনীতি, রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টিতে সদাজাগ্রত ছিলেন তিনি। ধারাবাহিক বিতর্কসভা ছাড়াও শিক্ষাঙ্গনে শরীরচর্চার জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন। তদানীন্তন সেচ আধিকারিক এক সাহেবের সহায়তায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ব্যাডমিন্টন কোর্ট বানান এই প্রধান শিক্ষক।
ব্রাহ্মধর্মকে রাজনারায়ণ দক্ষিণবঙ্গে প্রসারিত করেন। মেদিনীপুর শহরে ব্রাহ্ম ধর্মের উপাসনালয় নির্মিত হয়, তাঁর বাংলোর অদূরে। বর্তমানে সেই সৌধের ভগ্নাবশেষ সরিয়ে একই জমিতে স্টুডেন্ট হেল্থ হোমের ভবন নির্মিত হয়েছে। এই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁর কন্যা স্বর্ণলতা দেবীর সাথে কৃষ্ণধন ঘোষের ব্রাহ্ম রীতিতে বিবাহ সম্পাদিত হয়। ঐতিহাসিক এই বিবাহ বাসরে পৌরৌহিত্য করেন অযোধ্যা নাথ পাকড়াশি। আচার্যের আসন অলংকৃত করেন কেশবচন্দ্র সেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বহু ব্রাহ্ম নেতা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে মেদিনীপুর শহরে সেদিন উপস্থিত হন। বলা বাহুল্য, ঋষি অরবিন্দ ছিলেন তাঁর দৌহিত্র।
সিপাই বিদ্রোহের সময় তিনি মেদিনীপুরে ছিলেন। নানাভাবে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে পুষ্ট করেছেন। নানা সভা সমিতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন আজীবন। ১৯৬০ সালে নিজে চিরদিনের জন্য মদ্য পান ত্যাগ করেন। গঠন করেন -সুরা পান নিবারণী সভা (১৮৬১)। সমাজে আলোড়ন তোলে এই ঘটনা। যার অভিঘাতে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে সুরাপান বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ঐ সময়ে টেকচাঁদ ঠাকুর লিখেছিলেন – মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায় (১৮৬০)।
রাজনারায়ণ বসুর অন্য একটি ঐতিহাসিক কীর্তি হলো -‘ জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা’ গঠন। যার অনুপ্রেরণায় নবগোপাল মিত্র ‘হিন্দু মেলা’ প্রচলন করেন। তিনিই প্রথম পয়লা জানুয়ারির বদলে পয়লা বৈশাখ নব বর্ষ পালনের রীতি প্রচারিত করেন। শুধু তাই নয়, গুড মর্নিং নয়, ‘সুপ্রভাত’ এবং গুড নাইট নয় ,’সুরজনী’ সম্ভাষণের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। এই জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভার সভ্যদের মধ্যে পারস্পরিক মত বিনিময়ের সময় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। রীতিমতো একটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহারে ১ পয়সা জরিমানা প্রদানের রেওয়াজ ছিল ।
১৮৬৬ সালে অসুস্থতার কারণে হঠাত্ মেদিনীপুর শহর ত্যাগ করেন তিনি। ১৮৬৮ সাল থেকে বাকি জীবন দেওঘরে কাটিয়েছেন তিনি। মেদিনীপুর শহরে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন, যা বর্তমানে ঋষি রাজনারায়ণ বালিকা বিদ্যালয় নামে বিখ্যাত। তাঁর স্মৃতিতে এখানে একটি গ্রন্থাগারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনারায়ণের আচমকা শহর ত্যাগের পর শিক্ষিত নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ১৬৫ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি বিদায় জ্ঞাপক অভিজ্ঞান পত্র ও নগদ সাত শত টাকা তাঁর কাছে প্রেরণ করা হয়।
জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সংগে তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ইংরেজী খাঁ ‘ উপাধি প্রদান করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সঞ্জীবনী সভা’ নামে যে গুপ্ত সমিতি (১৮৭৬)গড়ে তোলেন সেখানেও সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথ এই সভার জন্য তাঁর বিখ্যাত গীত রচনা করেন- ‘একই সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন’। রাজনারায়ণের সাথে সাক্ষাতের জন্য সুদূর দেওঘরে যান রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮৭ সালের ১৭আগস্ট উভয়ের সাক্ষাৎ হয়। সেখানে আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে সহ বেশ কয়েকটি ব্রাহ্ম সংগীত পরিবেশন করে ঋষি রাজনারায়ণকে প্রীত করেন রবীন্দ্রনাথ।
কোনো কোনো গবেষক রাজনারায়ণকে ঈশ্বরচন্দ্রের ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিধবা বিবাহকে উৎসাহিত করতে নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন মানুষটি। বৃদ্ধ হিন্দুর আশা(১৮৮০) নামক একটি পুস্তিকা রচনা করে হিন্দু সমাজে ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছিলেন তিনি। নানা বিষয়ে বহু মননশীল প্রবন্ধ রচনা ও অনুবাদ করেন তিনি। যার দুটি মেদিনীপুর বসবাস কালে রচিত। ‘ধর্মতত্ত্বদীপিকা’ ও ‘ব্রহ্মসাধন’ গ্রন্থ। এই প্রথমে উল্লিখিত গ্রন্থটি রচনায় দীর্ঘ সময় ব্যয়িত হয়। অসুস্থ হয়ে যান তিনি। তাই মজা করে বলেছেন- ‘ঐ বেটি আমাকে খেলে’।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন তাঁর সহপাঠী এবং অকৃত্রিম ব্ন্ধু। মেঘনাদ বধ কাব্য রচনার পর প্রথম তিনটি সর্গ ডাকযোগে মেদিনীপুর শহরে বন্ধুর পাঠ প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশায় প্রেরণ করেন মহাকবি। এই গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করেন রাজনারায়ণ। শুধু তাই নয়, মধুকে লেখা তাঁর সব অমূল্য চিঠিও রচিত হয় মেদিনীপুরের মাটিতে। ইন্ডিয়া ফিল্ড পত্রিকায় ‘তিলোত্তমা সম্ভব’ কাব্যের আলোচনা করেছিলেন রাজনারায়ণ।
মুক্তমনা এই মানুষটি হিন্দু ধর্মের পুনর্মূল্যায়ণে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছেন। নানা লেখায় ও ভাষণে তা বিধৃত রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যথার্থ মূল্যায়ণ করে লিখেছেন ‘একদিকে তিনি আপনার জীবন এবং সংসারটিকে ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া দিয়াছিলেন, আর একদিকে দেশের উন্নতি সাধন করিবার জন্য তিনি সর্বদাই কতরকমের সাধ্য ও অসাধ্য প্ল্যান করিতেন, তাহার অন্ত নাই।’
রাজনারায়ণের ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মহা প্রয়াণের পর পরিবারের সদস্যগণ শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত করেন মরমী ব্রহ্মসংগীত -‘ মিটিল সকল ক্ষুধা,তাহার প্রেম সুধা, চলো রে ঘরে লয়ে যাই’।